ওমরাহ ট্রাভেল টিপস: ভ্রমণের আগে যেসব বিষয় মাথায় রাখা দরকার

Blog Details
ওমরাহ ট্রাভেল টিপস: ভ্রমণের আগে যেসব বিষয় মাথায় রাখা দরকার

ওমরাহ একটি পবিত্র তীর্থযাত্রা, যা মুসলিমদের জন্য আধ্যাত্মিকভাবে অত্যন্ত তাৎপর্যপূর্ণ। এটি শুধু মক্কায় কাবা শরীফের চারপাশে তাওয়াফ বা সাফা-মারওয়ায় সায়ী করার মধ্যে সীমাবদ্ধ নয়, বরং এটি একটি গভীর আত্মিক অভিজ্ঞতা, যা আল্লাহর সান্নিধ্য লাভের একটি সুযোগ। তবে, এই যাত্রা সফল ও স্মরণীয় করতে প্রয়োজন সঠিক পরিকল্পনা, শারীরিক ও মানসিক প্রস্তুতি এবং বিস্তারিত জানাশোনা।


এখানে আমরা ওমরাহ ভ্রমণের জন্য প্রয়োজনীয় টিপসগুলো বিস্তারিতভাবে আলোচনা করব, প্রতিটি পয়েন্টে গভীরভাবে আলোকপাত করে, যাতে আপনার যাত্রা হয় নির্বিঘ্ন ও আধ্যাত্মিকভাবে পরিপূর্ণ।ওমরা হজ পালন শুধু একটি ধর্মীয় অনুশীলন নয়, বরং এটি একজন মুসলমানের জীবনে আধ্যাত্মিক পুনর্জাগরণের একটি মহান সুযোগ।

 

ওমরাহ সম্পর্কে প্রাথমিক ধারণা

ওমরাহ মুসলিমদের জন্য একটি ঐচ্ছিক সুন্নত ইবাদত, যা হজের মতো বাধ্যতামূলক না হলেও এর আধ্যাত্মিক মূল্য অপরিসীম।ওমরাহ শুরু করলে তা পূর্ণ করা ওয়াজিব। এটি মক্কার মসজিদুল হারামে কাবা শরীফের চারপাশে সাতবার তাওয়াফ, সাফা ও মারওয়া পাহাড়ের মধ্যে সাতবার সায়ী, এবং মাথা মুণ্ডন বা চুল ছাটার মাধ্যমে সম্পন্ন হয়।


ওমরাহর প্রতিটি ধাপের পেছনে রয়েছে গভীর ঐতিহাসিক ও ধর্মীয় তাৎপর্য। উদাহরণস্বরূপ, সায়ী হযরত হাজেরা (আ.)-এর পানির সন্ধানে দৌড়ানোর স্মৃতি বহন করে, যা আমাদের ধৈর্য ও বিশ্বাসের শিক্ষা দেয়।


ওমরাহ পালনের জন্য আপনার প্রথমেই এর ধর্মীয় তাৎপর্য বোঝা দরকার। এটি শুধু কিছু আচার-অনুষ্ঠান পালন নয়, বরং আল্লাহর প্রতি পূর্ণ সমর্পণ ও নিজেকে পবিত্র করার একটি প্রক্রিয়া।


তাই ভ্রমণের আগে ওমরাহর নিয়ম-কানুন, দোয়া, এবং এর ফজিলত সম্পর্কে জানতে হবে।


আপনি স্থানীয় আলেম বা ওমরাহ গাইডবুক থেকে শিখতে পারেন। অনলাইনে অনেক ভিডিও টিউটোরিয়ালও পাওয়া যায়, যেখানে বিস্তারিতভাবে প্রতিটি ধাপ ব্যাখ্যা করা হয়।


এছাড়া, ওমরাহর সময় যে তালবিয়া পড়া হয় (লাব্বাইক আল্লাহুম্মা লাব্বাইক), তা মুখস্থ করা এবং এর অর্থ বোঝা আপনার ইবাদতকে আরও অর্থবহ করবে।


ওমরাহ ওমরাহর পাশাপাশি অনেকে মদিনার মসজিদে নববীতে রাসূলুল্লাহ (সা.)-এর রওজা জিয়ারত করেন। এটি ওমরাহর অংশ না হলেও, এটি ভ্রমণের একটি গুরুত্বপূর্ণ অংশ। তাই মদিনায় থাকার সময় সেখানকার শিষ্টাচার, যেমন সালাম পেশ করা বা নফল নামাজ পড়া, সম্পর্কে জানা জরুরি। 


ভ্রমণের পরিকল্পনা

ওমরাহ ভ্রমণ একটি সাধারণ ট্যুর নয়, এটি একটি আধ্যাত্মিক অভিযান। তাই এর জন্য সঠিক পরিকল্পনা অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ। এই পরিকল্পনায় সময় নির্বাচন, বাজেট, এবং ট্রাভেল এজেন্সির মতো বিষয়গুলো গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করে।


উপযুক্ত সময় নির্বাচন

ওমরাহ যেকোনো সময় করা যায়, তবে সময় নির্বাচন আপনার অভিজ্ঞতাকে বদলে দিতে পারে। উদাহরণস্বরূপ, রমজান মাসে ওমরাহ পালনের ফজিলত অনেক বেশি। হাদিসে আছে, রমজানে ওমরাহ পালন হজের সমতুল্য। কিন্তু এই সময় মক্কা ও মদিনায় ভিড় থাকে অত্যধিক। হোটেল, পরিবহন, এমনকি মসজিদুল হারামে তাওয়াফের জন্যও অপেক্ষা করতে হয়। তাই আপনি যদি ভিড় এড়াতে চান, তবে রমজানের বাইরে অন্য সময় বেছে নিতে পারেন।


শীতকাল (নভেম্বর-ফেব্রুয়ারি) সৌদি আরবের জন্য আদর্শ সময়। তাপমাত্রা ১৫-২৫ ডিগ্রি সেলসিয়াসের মধ্যে থাকে, যা হাঁটা ও বাইরে সময় কাটানোর জন্য আরামদায়ক। গ্রীষ্মকালে (জুন-আগস্ট) তাপমাত্রা ৪০ ডিগ্রি ছাড়িয়ে যায়, যা শারীরিকভাবে চ্যালেঞ্জিং হতে পারে, বিশেষ করে বয়স্ক বা দুর্বল স্বাস্থ্যের মানুষদের জন্য। তবে এই সময় ভিড় কম থাকে এবং প্যাকেজের খরচও কম হয়।


আপনার ব্যক্তিগত সুবিধাও বিবেচনা করুন। যেমন, চাকরিজীবীদের জন্য ছুটির সময় বেছে নেওয়া উচিত। বাচ্চাদের সঙ্গে ভ্রমণ করলে স্কুলের ছুটির সময় বিবেচনা করুন। এছাড়া, সৌদি আরবের আবহাওয়া এবং স্থানীয় ছুটির দিনগুলো (যেমন, ঈদ) সম্পর্কে জেনে নিন, কারণ এই সময়ে স্থানীয় পরিষেবাগুলো প্রভাবিত হতে পারে।


বাজেট নির্ধারণ

ওমরাহ ভ্রমণের খরচ বেশ বড় একটি বিষয়। বাংলাদেশ থেকে গড়ে একজন ব্যক্তির জন্য খরচ হতে পারে ১,৫০,০০০ থেকে ৩,৫০,০০০ টাকা। তবে এটি নির্ভর করে প্যাকেজের ধরন, হোটেলের মান, এবং ভ্রমণের সময়ের উপর।


খরচের বিভিন্ন দিক:


  • বিমান ভাড়া: ঢাকা থেকে জেদ্দা বা মদিনার ফ্লাইটের খরচ ৫০,০০০ থেকে ১,০০,০০০ টাকার মধ্যে হতে পারে। অফ-সিজনে টিকিট সস্তা পাওয়া যায়।
  • ভিসা ফি: ওমরাহ ভিসার জন্য ফি সাধারণত ট্রাভেল এজেন্সি প্যাকেজে অন্তর্ভুক্ত থাকে। তবে আলাদাভাবে আবেদন করলে ১০,০০০-১৫,০০০ টাকা লাগতে পারে।
  • আবাসন: মক্কা ও মদিনায় হোটেলের খরচ নির্ভর করে মসজিদের নৈকট্যের উপর। মসজিদুল হারামের কাছাকাছি হোটেলগুলোর দাম বেশি, প্রতি রাতে ৫,০০০-১৫,০০০ টাকা। দূরের হোটেলগুলো সস্তা, তবে পরিবহন খরচ বাড়তে পারে।
  • পরিবহন: মক্কা, মদিনা, এবং জেদ্দার মধ্যে বাস বা প্রাইভেট কারের খরচ ১০,০০০-২০,০০০ টাকা হতে পারে।
  • খাবার: হোটেলে বুফে খাবারের খরচ প্রতিদিন ২,০০০-৫,০০০ টাকা। স্থানীয় রেস্তোরাঁয় খেলে খরচ কম হতে পারে।
  • অন্যান্য: কেনাকাটা, দান-খয়রাত, বা অতিরিক্ত ক্রিয়াকলাপের জন্য ১০,০০০-২০,০০০ টাকা রাখুন।

*খরচ শুধুমাত্র ধারনা দেবার জন্য, এজেন্সি থেকে প্যাকেজ নেয়ার সময় বিস্তারিত জেনে নিন


বাজেট কমানোর টিপস:


ওমরাহ করতে গেলে অনেক খরচ হতে পারে, তবে কিছু সচেতন পরিকল্পনার মাধ্যমে বাজেট কমানো সম্ভব। নিচে ওমরাহর বাজেট কমানোর কিছু কার্যকর টিপস দেওয়া হলো:

 

  • আগে থেকে ফ্লাইট বুক করুন।
  • অফ-সিজনে ভ্রমণ করুন।রমজান ও হজ মৌসুমে খরচ বেশি হয়। তাই অপেক্ষাকৃত শান্ত সময়ে গেলে ফ্লাইট ও অন্যান্য খরচ অনেক কমে যায়।
  • একাধিক ট্রাভেল এজেন্সির প্যাকেজ তুলনা করুন। এক্ষেত্রে গুগলের সাহায্য নিতে পারেন।
  • গ্রুপে ভ্রমণ করলে খরচ ভাগ হয়ে যায়।
  • অপ্রয়োজনীয় কেনাকাটা এড়িয়ে চলুন।
  • হোটেল খরচ কম করার জন্য আপনি চাইলে সৌদি আরবে গিয়ে একটু ঘুরে ফিরে রুম খুঁজে নিতে পারেন।


নির্ভরযোগ্য ট্রাভেল এজেন্সি নির্বাচন

একটি ভালো ট্রাভেল এজেন্সি আপনার ওমরাহকে সহজ ও ঝামেলামুক্ত করতে পারে। কিন্তু ভুল এজেন্সি বেছে নিলে সমস্যা হতে পারে। বাংলাদেশে বিভিন্ন ট্রাভেল এজেন্সীগুলো ওমরাহ পালনের জন্য যাবতীয় প্যাকেজ অফার করে। তবে সবাই নির্ভরযোগ্য নয়।


এজেন্সি নির্বাচনের টিপস:


  • রেজিস্ট্রেশন যাচাই:ওমরাহ ট্রাভেল এজেন্সির রেজিস্ট্রেশন যাচাই করা খুবই গুরুত্বপূর্ণ, কারণ এটি আপনার যাত্রার নিরাপত্তা ও নিশ্চয়তা নিশ্চিত করে। বাংলাদেশ সরকার অনুমোদিত হজ এজেন্সির তালিকা প্রকাশ করে থাকে। এটি পাওয়া যায় ধর্ম মন্ত্রণালয়ের ওয়েবসাইটে ।সেখানে “হজ এজেন্সি তালিকা” বা “ওমরাহ এজেন্সি তালিকা” সেকশনে গিয়ে যাচাই করতে পারেন।
  •  লাইসেন্স নম্বর চেক করুন:প্রতিটি বৈধ হজ বা ওমরাহ এজেন্সির একটি লাইসেন্স নম্বর থাকে। এজেন্সির কাছ থেকে তা চেয়ে নিন এবং সরকারিভাবে যাচাই করুন।
  •  অভিযোগ ও রিভিউ যাচাই করুন:ফেসবুক, গুগল রিভিউ, কিংবা হজ অফিসে জমা পড়া অভিযোগের ভিত্তিতে একটি এজেন্সির অতীত সুনাম যাচাই করা যায়।
  •  চুক্তিপত্র না দেখে কখনোই টাকা পরিশোধ করবেন না:সব সময় লিখিত চুক্তি করুন, যেখানে প্যাকেজের সব বিস্তারিত, টাকা ফেরতের শর্ত, ও ভিসার নিশ্চয়তা থাকবে। এজেন্সিটি সৌদি সরকার ও বাংলাদেশের পর্যটন মন্ত্রণালয়ের অনুমোদিত কিনা দেখুন। সব শর্ত লিখিতভাবে নিন। মৌখিক প্রতিশ্রুতির উপর ভরসা করবেন না। 
  • রিভিউ ও রেফারেন্স: পূর্ববর্তী গ্রাহকদের রিভিউ পড়ুন। পরিচিত কেউ যদি তাদের সার্ভিস নিয়ে থাকে, তাদের সাথে কথা বলুন।
  • প্যাকেজের বিস্তারিত: হোটেলের অবস্থান, পরিবহনের ধরন, গাইড সুবিধা, এবং খাবারের ব্যবস্থা সম্পর্কে জানুন। কিছু এজেন্সি সস্তা প্যাকেজ দিয়ে পরে অতিরিক্ত চার্জ করে।
  • গাইডের গুণমান: ওমরাহর সময় একজন অভিজ্ঞ গাইড আপনাকে নিয়ম-কানুন শেখাতে এবং সমস্যা সমাধানে সাহায্য করতে পারে।এজেন্সির সাথে যোগাযোগের সময় স্পষ্ট প্রশ্ন করুন। যেমন, হোটেল মসজিদ থেকে কত দূর? পরিবহন কি শীতাতপ নিয়ন্ত্রিত? জরুরি পরিস্থিতিতে তাদের সাপোর্ট কেমন? একটি ভালো এজেন্সি আপনার ভ্রমণকে স্মরণীয় করে তুলবে।

 

ভিসা ও ডকুমেন্টেশন

ওমরাহ ভ্রমণের জন্য সঠিক ডকুমেন্টেশন অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ। একটি ছোট ভুলও আপনার ভ্রমণ বাতিল করে দিতে পারে। তাই এই বিষয়ে বিস্তারিত জানা ও প্রস্তুতি নেওয়া জরুরি।


ওমরাহ ভিসা

ওমরাহ ভিসা সৌদি আরবের সরকার কর্তৃক নিয়ন্ত্রিত। বাংলাদেশ থেকে ভিসার জন্য সাধারণত ট্রাভেল এজেন্সির মাধ্যমে আবেদন করতে হয়। সৌদি সরকারের নতুন নিয়ম অনুযায়ী, অনলাইন প্ল্যাটফর্ম  Nusuk অ্যাপ ব্যবহার করা হয়।

  • প্রয়োজনীয় কাগজপত্র:
  • পাসপোর্ট: কমপক্ষে ৬ মাসের মেয়াদ থাকতে হবে। 
  • ছবি:  Nusuk অ্যাপ ব্যবহার করে ডিজিটাল সেলফি নেয়া হবে।
  • ভ্যাকসিনেশন সার্টিফিকেট: মেনিনজাইটিস  ভ্যাকসিনের প্রমাণ দিতে হবে।
  • মাহরামের তথ্য: মহিলাদের জন্য মাহরামের (নিকটাত্মীয় পুরুষ) তথ্য প্রয়োজন। ৪৫ বছরের বেশি বয়সী মহিলারা কিছু ক্ষেত্রে মাহরাম ছাড়া ভ্রমণ করতে পারেন, তবে এজেন্সির সাথে নিশ্চিত করুন।

 

ভিসা প্রক্রিয়া:

  • এজেন্সির মাধ্যমে আবেদন করলে তারা কাগজপত্র সংগ্রহ ও জমা দেবে। তবে  Nusuk অ্যাপ ব্যবহার করে বায়োম্যাট্রিক এনরোলমেন্ট করতে হবে। 
  • ভিসা প্রক্রিয়ায় ৭-১৫ দিন সময় লাগতে পারে।
  • ভিসা অনুমোদনের পর ই-ভিসা ইস্যু হবে।

 স্বাস্থ্য সংক্রান্ত ডকুমেন্ট

সৌদি আরব স্বাস্থ্য নিরাপত্তার বিষয়ে কঠোর। তাই কিছু স্বাস্থ্য সংক্রান্ত শর্ত পূরণ করতে হবে।


  • মেনিনজাইটিস ভ্যাকসিন: এটি বাধ্যতামূলক। ভ্রমণের কমপক্ষে ১০ দিন আগে ভ্যাকসিন নিতে হবে এবং সার্টিফিকেট সংগ্রহ করতে হবে।
  • স্বাস্থ্য পরীক্ষা: বয়স্ক বা দীর্ঘস্থায়ী রোগে আক্রান্ত ব্যক্তিদের জন্য ডাক্তারের ফিটনেস সার্টিফিকেট প্রয়োজন হবে।


এছাড়া, সৌদি আরবে প্রবেশের সময় স্বাস্থ্য পরীক্ষা বা তাপমাত্রা পরীক্ষা হতে পারে। তাই ভ্রমণের আগে নিজের স্বাস্থ্যের প্রতি যত্নশীল হন।


 অন্যান্য কাগজপত্র

  • বিমান টিকিট: টিকিটের ফটোকপি এবং ডিজিটাল কপি রাখুন।
  • হোটেল বুকিং: এজেন্সি থেকে হোটেলের নিশ্চিতকরণ পত্র নিন।
  • ট্রাভেল ইন্স্যুরেন্স: এটি ঐচ্ছিক, তবে চিকিৎসা বা জরুরি পরিস্থিতির জন্য সুপারিশ করা হয়।
  • সমস্ত কাগজপত্রের ফটোকপি একটি আলাদা ফোল্ডারে রাখুন। এছাড়া, গুগল ড্রাইভ বা ইমেইলে ডিজিটাল কপি সংরক্ষণ করুন, যাতে প্রয়োজনে দ্রুত অ্যাক্সেস করা যায়।

আধ্যাত্মিক প্রস্তুতি

ওমরাহ শুধু শারীরিক ভ্রমণ নয়, এটি একটি আত্মার যাত্রা। তাই ভ্রমণের আগে নিজেকে আধ্যাত্মিকভাবে প্রস্তুত করা জরুরি।


ওমরাহর নিয়ম-কানুন শেখা

হজের আগে নারী-পুরুষের ওমরা পালনের ধারাবাহিক নিয়মগুলো যেমন জেনে নেয়া জরুরি। তেমনি ওমরার রোকনগুলোতে পড়া দোয়া গুলোও জেনে নেয়া জরুরি।ওমরাহর প্রতিটি ধাপ ইহরাম, তাওয়াফ, সায়ী, এবং মাথা মুণ্ডন এর নির্দিষ্ট নিয়ম রয়েছে। উদাহরণস্বরূপ, ইহরামের সময় কিছু কাজ নিষিদ্ধ, যেমন সুগন্ধি ব্যবহার, নখ কাটা, বা স্বামী-স্ত্রীর সম্পর্ক। এই নিয়ম না জানলে অজান্তে ভুল হতে পারে।

কীভাবে শিখবেন:

  • স্থানীয় মসজিদের আলেমের কাছ থেকে শিখুন।
  • ওমরাহ গাইডবুক পড়ুন, যেমন আল-মাকতাবাতুল বুরহান-এর বই।
  • ইউটিউবে আরবি বা বাংলায় ওমরাহ টিউটোরিয়াল দেখুন।
  • তালবিয়া, তাওয়াফের দোয়া, এবং সায়ীর দোয়া মুখস্থ করুন।
  • এছাড়া, ওমরাহর সময় কোন ভুল হলে কীভাবে কাফফারা দেওয়া যায়, তাও জেনে রাখুন।

নিয়ত পাকা করা

ওমরাহর সফলতা নির্ভর করে আপনার নিয়তের উপর। এটি শুধুমাত্র আল্লাহর সন্তুষ্টির জন্য হওয়া উচিত। ভ্রমণের আগে নিজের মন পরীক্ষা করুন। কোনো পাপ বা গুনাহ থাকলে তওবা করুন। নিয়মিত ইস্তিগফার পড়ুন এবং দোয়া করুন যেন আল্লাহ আপনার ওমরাহ কবুল করেন।


নিয়তের সাথে ধৈর্যও জরুরি। ওমরাহর সময় ভিড়, দীর্ঘ অপেক্ষা, বা অন্যান্য অসুবিধা হতে পারে। এগুলোকে আল্লাহর পরীক্ষা হিসেবে গ্রহণ করুন।


ধৈর্য ও সহনশীলতা অর্জন

ওমরাহর সময় ধৈর্য পরীক্ষা হয়। উদাহরণস্বরূপ, তাওয়াফের সময় ভিড়ে ধাক্কাধাক্কি হতে পারে। গরমে হাঁটতে অসুবিধা হতে পারে। এই পরিস্থিতিতে ধৈর্য ধরা জরুরি। ভ্রমণের আগে নিজেকে এই পরিস্থিতির জন্য মানসিকভাবে প্রস্তুত করুন। নিয়মিত জিকির ও দোয়া পড়লে মন শান্ত থাকে।

 

শারীরিক প্রস্তুতি

ওমরাহর জন্য শারীরিকভাবে ফিট থাকা জরুরি, কারণ এতে অনেক হাঁটা, দাঁড়ানো, এবং শারীরিক পরিশ্রম জড়িত।


ফিটনেস প্রশিক্ষণ

তাওয়াফে প্রায় ১.৫ কিলোমিটার এবং সায়ীতে ৩.৫ কিলোমিটার হাঁটতে হয়। তাই ভ্রমণের কয়েক মাস আগে থেকে প্রস্তুতি শুরু করুন।


  • হাঁটা: প্রতিদিন ৩০-৪৫ মিনিট হাঁটুন। ধীরে ধীরে দূরত্ব বাড়ান।
  • ব্যায়াম: স্ট্রেচিং, যোগব্যায়াম, বা হালকা শক্তি প্রশিক্ষণ করুন।
  • হুইলচেয়ার ব্যবহার: বয়স্ক বা শারীরিকভাবে দুর্বল ব্যক্তিরা মসজিদুল হারামে হুইলচেয়ার সুবিধা নিতে পারেন। এজেন্সির সাথে এটি নিশ্চিত করুন।

 

স্বাস্থ্য পরীক্ষা

  • ডাক্তারের পরামর্শ: ভ্রমণের আগে একজন ডাক্তারের সাথে কথা বলুন। হৃদরোগ, ডায়াবেটিস, বা উচ্চ রক্তচাপ থাকলে বিশেষ যত্ন নিন।
  • ওষুধ: প্রয়োজনীয় ওষুধ সাথে নিন। প্রেসক্রিপশনের কপি রাখুন।
  • হাইড্রেশন: গরমে পানিশূন্যতা এড়াতে নিয়মিত পানি পান করুন। সেখানে দিনে অনেক বেশি তাপমাত্রা থাকে ।শরীর ডিহাইড্রেট হয়ে গেলে অসুস্থ হয়ে যেতে পারেন । তাই প্রচুর পরিমানে পানি পান করুন এবং তেলজাতীয় খাবার এড়িয়ে চলুন।

 

প্যাকিং গাইড

সঠিক প্যাকিং আপনার ভ্রমণকে আরামদায়ক করবে।

পোশাক

  • ইহরাম: পুরুষদের জন্য দুই টুকরো সাদা কাপড়। মহিলাদের জন্য শালীন পোশাক।
  • জুতা: আরামদায়ক স্যান্ডেল বা স্নিকার্স।
  • শীতের পোশাক: শীতকালে হালকা জ্যাকেট বা শাল নিন।

প্রয়োজনীয় জিনিসপত্র

  • কাগজপত্রের ফটোকপি।
  • ফার্স্ট এইড কিট, সানস্ক্রিন, এবং ছাতা।
  • জায়নামাজ, তসবিহ, এবং ছোট কোরআন।
  • চার্জার, পাওয়ার ব্যাংক, এবং অ্যাডাপ্টার।

খাবার

  • শুকনো খাবার (বাদাম, মুড়ি, চানাচুর,বিস্কুট)।
  • ডায়াবেটিস বা বিশেষ ডায়েটের জন্য খাবার। 

মক্কা ও মদিনায় থাকার সময়

মক্কা ও মদিনায় থাকার সময় কিছু বিষয় মাথায় রাখুন।


সময় ব্যবস্থাপনা

  • নামাজের সময়সূচি মেনে চলুন।
  • অফ-পিক সময়ে তাওয়াফ ও সায়ী করুন।
  • মদিনায় রওজা জিয়ারতের সময় মেনে চলুন।

স্থানীয় নিয়ম-কানুন

মসজিদে ছবি তোলা এড়িয়ে চলুন। দেশটির হজ ও ওমরা বিষয়ক মন্ত্রণালয় জানিয়েছে, পবিত্র কাবা তাওয়াফ ও সায়ির আনুষ্ঠানিকতা পালনের সময় ছবি তোলার কিছু শিষ্টাচার রয়েছে, আগতদের এসবের প্রতি যত্ন নেয়া উচিত।এ লক্ষ্যে মসজিদে হারামে ফটোগ্রাফি সংক্রান্ত চারটি নির্দেশনা প্রদান করেছে। যাতে ওমরা পালনকারী ও নামাজিদের চলাচল এবং ইবাদত-বন্দেগিতে কোনো বাধা সৃষ্টি না হয়।


মন্ত্রণালয়ের এক্স অ্যাকাউন্টে দেয়া নির্দেশনায় বলা হয়, দর্শনার্থীদের উচিত মানুষ চলাচলের রাস্তা থেকে দূরে দাঁড়িয়ে ছবি তোলা। কারও গোপনীয়তা লঙ্ঘিত হয় এমন ছবি তোলা থেকে বিরত থাকা। সেই সঙ্গে অনুমতি ছাড়া অন্যের ছবি তোলা এড়িয়ে চলা এবং দ্রুত সময়ে ও সম্মানের সঙ্গে ছবি ওঠানো।হজ-ওমরার সময় বেশি বেশি ইবাদত-বন্দেগিতে মশগুল থেকে সময়কে কাজে লাগানোর পরামর্শ দিয়ে বলা হয়, সবার খেয়াল রাখা উচিত, মানুষ চলাচলের রাস্তায় দাঁড়িয়ে ছবি তোলার কারণে যেন যানজটের সৃষ্টি না হয়। যা অন্যদের অসুবিধার কারণ হয়।উল্লেখ্য, সাম্প্রতিক বছরগুলোতে দেখা গেছে মক্কার মসজিদে হারাম ও মদিনার মসজিদে নববিতে যাওয়া মুসল্লিরা ব্যাপকহারে ছবি ও ভিডিও রেকর্ড করা শুরু করেছেন। এটা নিয়ে নানা সময় মসজিদ হারামের ইমামরা বিরক্তি প্রকাশের পাশাপাশি ছবি তোলা ও ভিডিও করাকে নিরুৎসাহিত করে বক্তব্য দিয়েছেন।


মহিলারা মাহরামের সাথে থাকুন।


স্থানীয় আইন মানুন। উদাহরণস্বরূপ - সৌদি পাবলিক সিকিউরিটি ডিরেক্টরেটের ঘোষণা অনুযায়ী, হজের সময় মক্কায় প্রবেশ করতে সবাইকে সরকারি অনুমতিপত্র নিতে হবে।


নিরাপত্তা

ব্যক্তিগত জিনিসপত্রের প্রতি সতর্ক থাকুন।

কিছু ইমারজেন্সি নম্বর জেনে রাখুন, চাইলে নোট করেও রাখতে পারেনঃ

  • পুলিশ: ৯৯৯ 
  • সৌদি অ্যাম্বুলেন্স: ৯৯৭ 
  • সিভিল ডিফেন্স: ৯৯৮ 
  • সৌদি ট্রাফিক পুলিশ: ৯৯৩ 
  • হাইওয়ে পেট্রল: ৯৯৬ 
  • জেনারেল ডিরেক্টরেট অব বর্ডার গার্ড: ৯৯৪


ফিরে আসার পর

ওমরাহ শেষে আধ্যাত্মিক শান্তি ধরে রাখুন। নিয়মিত নামাজ, জিকির, এবং দোয়ার মাধ্যমে আল্লাহর সান্নিধ্য বজায় রাখুন। অভিজ্ঞতা পরিবারের সাথে শেয়ার করুন। নবিজি সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম যখন সফর থেকে বাড়ি ফিরতেন, তখন সর্বপ্রথম মসজিদে গিয়ে দুই রাকাত নামাজ পড়তেন। তাই হজের দীর্ঘ সফর শেষে হজ পালনকারীরা যখন নিজ নিজ বাড়িতে পৌঁছবে, তখন তারা নবিজির সুন্নত অনুযায়ী নিজ নিজ মহল্লার মসজিদে গিয়ে দুই রাকাত নামাজ আদায় করবে। এরপর ঘরে যাবে। আর যদি কেউ ঘরে যায় তবে সফরের ক্লান্তি সেরে পরিচ্ছন্ন হয়ে হলেও মসজিদে গিয়ে দুই রাকাত নামাজ আদায় করবেন।


ওমরাহ ট্রাভেল টিপস: কিছু সাধারন প্রশ্ন-উত্তর (FAQs)

 

প্রশ্নঃ ওমরাহ কী এবং এটি কি বাধ্যতামূলক?

উত্তরঃ ওমরাহ মক্কায় কাবা শরীফের তাওয়াফ, সাফা-মারওয়ায় সায়ী এবং মাথা মুণ্ডন বা চুল ছাটার মাধ্যমে সম্পন্ন একটি ইবাদত। এটি বাধ্যতামূলক নয়, তবে আধ্যাত্মিক ফজিলত অনেক।


প্রশ্নঃ ওমরাহ ভ্রমণের সেরা সময় কোনটি?

উত্তরঃ রমজানে ফজিলত বেশি, তবে ভিড় বেশি। শীতকাল (নভেম্বর-ফেব্রুয়ারি) আরামদায়ক। গ্রীষ্মকালে (জুন-আগস্ট) খরচ কম, তবে গরম।


প্রশ্নঃ ওমরাহ ভ্রমণের গড় খরচ কত?

উত্তরঃ বাংলাদেশ থেকে ১,৫০,০০০ থেকে ৩,৫০,০০০ টাকা, প্যাকেজ, হোটেল ও সময়ের উপর নির্ভর করে।


প্রশ্নঃ ওমরাহ ভিসার জন্য কী কী কাগজপত্র প্রয়োজন?

উত্তরঃ বৈধ পাসপোর্ট, ছবি, মেনিনজাইটিস ও কোভিড ভ্যাকসিন সার্টিফিকেট, মাহরামের তথ্য (প্রযোজ্য হলে) এবং কিছু ক্ষেত্রে ব্যাংক স্টেটমেন্ট।


প্রশ্নঃ মহিলারা কি একা ওমরাহ করতে পারেন?

উত্তরঃ ৪৫ বছরের কম বয়সী মহিলাদের মাহরাম প্রয়োজন। ৪৫ বছরের বেশি হলে গ্রুপ বা এজেন্সির তত্ত্বাবধানে একা যাওয়া যায়, নিয়ম নিশ্চিত করুন।


প্রশ্নঃ ওমরাহর জন্য শারীরিক প্রস্তুতি কীভাবে নেব?

উত্তরঃ ২-৩ মাস আগে থেকে প্রতিদিন হাঁটুন, হালকা ব্যায়াম করুন, পানি পান করুন। বয়স্করা হুইলচেয়ার ব্যবহার করতে পারেন। ডাক్తারের পরামর্শ নিন।


প্রশ্নঃ ওমরাহর সময় কী কী জিনিস সাথে নেওয়া উচিত?

উত্তরঃ ইহরাম পোশাক, আরামদায়ক জুতা, কাগজপত্র, ফার্স্ট এইড কিট, জায়নামাজ, তসবিহ, শুকনো খাবার, চার্জার ও পাওয়ার ব্যাংক।


প্রশ্নঃ ওমরাহর সময় কী কী নিষিদ্ধ কাজ এড়ানো উচিত?

উত্তরঃ ইহরামে সুগন্ধি, নখ-চুল কাটা, স্বামী-স্ত্রীর সম্পর্ক, ঝগড়া, গাছ কাটা বা প্রাণী হত্যা নিষিদ্ধ। ভুল হলে কাফফারা দিতে হয়।


প্রশ্নঃ মক্কা ও মদিনায় থাকার সময় কীভাবে নিরাপদ থাকব?

উত্তরঃ পাসপোর্ট-টাকা কাছে রাখুন, গ্রুপে থাকুন, হোটেলের ঠিকানা লিখে রাখুন। জরুরি নম্বর (অ্যাম্বুলেন্স: ৯৯৭, পুলিশ: ৯৯৯) মনে রাখুন।


প্রশ্নঃ ওমরাহ শেষে কীভাবে আধ্যাত্মিক অভিজ্ঞতা ধরে রাখব?

উত্তরঃ নিয়মিত নামাজ, কোরআন তিলাওয়াত, জিকির করুন। নফল ইবাদত বাড়ান, শিক্ষা জীবনে প্রয়োগ করুন এবং অভিজ্ঞতা শেয়ার করুন।

 

ওমরাহ হজ মুসলিমদের জন্য এক মহান ইবাদত ও আত্মশুদ্ধির সুযোগ। এটি শারীরিক শ্রম, ধৈর্য, আত্মনিবেদন ও আধ্যাত্মিকতার এক অপূর্ব মিলনস্থল। কাবা শরিফের সামনে দাঁড়িয়ে আল্লাহর দরবারে আত্মসমর্পণ করা, তাওয়াফ, সাঈ এবং ইহরাম পালন এই সবই একজন মুসলমানকে ভেতর থেকে পরিবর্তন করতে সাহায্য করে।ওমরাহ পালন শুধুমাত্র একটি আনুষ্ঠানিকতা নয়, বরং এটি জীবনের নতুন পথচলার প্রেরণা। ওমরাহ শেষে একজন মুসলমান যেন আরো সদাচারী, ধৈর্যশীল ও পরিশুদ্ধ আত্মার অধিকারী হয়ে ওঠেন সেই কামনাই থাকে এই ইবাদতের অন্তরালের মূল উদ্দেশ্য।সঠিক পরিকল্পনা, আধ্যাত্মিক ও শারীরিক প্রস্তুতি, এবং সতর্কতার মাধ্যমে এটি আরও ফলপ্রসূ হবে। আল্লাহ আমাদের সকলের ওমরাহ কবুল করুন। আমীন।

 


Share
Comments
কমেন্ট করতে লগইন করুন। লগইন | রেজিস্ট্রেশন

No Data Found