ব্লগ

ইসলামের গুরুত্বপূর্ণ শিক্ষা, সঠিক নিয়ম-কানুন এবং ভ্রমণের জন্য প্রয়োজনীয় প্রস্তুতির সাথে সাথে বিভিন্ন পবিত্র স্থানের ইতিহাস ও দর্শনীয় স্থানসমূহের বিস্তারিত বর্ণনা থাকবে এখানে।

Blog Details
পুরুষ ও মহিলাদের জন্য হজের ইহরাম বাঁধার নিয়ম ও দোয়া

হজ ইসলামের পাঁচটি স্তম্ভের মধ্যে পঞ্চম হলেও প্রতিটি মুসলিমের হৃদয়ে এর মর্যাদা অনেক উঁচুতে। এটি এমন একটি ইবাদত, যার জন্য আমরা জীবনের বহুদিন ধরে স্বপ্ন দেখি, দোয়া করি, প্রস্তুতি নিই। আর যখন সেই কাঙ্ক্ষিত সফরের সময় আসে, তখন যাত্রার প্রথম ধাপ হয় ইহরাম । ইহরাম শুধুমাত্র দুটি সাদা কাপড় নয় এটি এক ধরনের মানসিক ও আত্মিক প্রস্তুতি। একটি বিশেষ অবস্থায় প্রবেশ, যেখানে দুনিয়ার সব চাওয়া-পাওয়া, ব্যস্ততা ও অহংবোধ ঝেড়ে ফেলে একজন মানুষ সম্পূর্ণভাবে আল্লাহর পথে নিজেকে সঁপে দেয়।


এই পর্বে রয়েছে কিছু নির্দিষ্ট নিয়ম, করণীয় ও নিষেধাজ্ঞা যা নারী ও পুরুষের ক্ষেত্রে কিছুটা ভিন্ন হতে পারে। এই লেখায় আমরা সহজভাবে জানবো, ইহরাম কীভাবে বাঁধতে হয়, কী দোয়া পড়তে হয়, কী কী বিষয় থেকে বিরত থাকতে হয় যাতে আমাদের হজের যাত্রা হয় সঠিক, সুন্দর ও আল্লাহর সন্তুষ্টির উপযুক্ত।

 

ইহরাম কী?

‘ইহরাম’ শব্দটি এসেছে আরবী "হারাম" শব্দ থেকে, যার অর্থ কিছু জিনিসকে নিজের ওপর নিষিদ্ধ করা। হজ বা উমরার সময় যখন একজন মুসলিম ইহরাম অবস্থায় প্রবেশ করেন, তখন এমন অনেক কাজ, যা সাধারণ সময় একেবারেই বৈধ তা তখন নিষিদ্ধ হয়ে যায়। যেমন: চুল কাটা, নখ ছাঁটা, সুগন্ধি ব্যবহার, এমনকি শিকার করাও। আসলে, ইহরাম মানেই শুধু পোশাকের পরিবর্তন নয় এটি একটা অন্তরের অবস্থাও। এটি এমন এক ঘোষণা, যেখানে একজন মানুষ বলেন: “আমি এখন আল্লাহর অতিথি, আমি দুনিয়ার সব সাজগোজ, আরাম-আয়েশ কিছু সময়ের জন্য ছেড়ে দিয়েছি, শুধু তাঁর সন্তুষ্টির জন্য।”এই সময়টা যেন এক ধরনের সংযমের অনুশীলন, নিজের ভেতরের আত্মাকে পরিশুদ্ধ করার একটি সুযোগ।

 

ইহরাম বাঁধার সময় ও স্থান (মীকাত):

হজ বা উমরার পথে বের হলে, একটা নির্দিষ্ট জায়গা পর্যন্ত পৌঁছানোর আগেই আমাদের ইহরাম বাঁধা বাধ্যতামূলক। সেই নির্দিষ্ট সীমা বা জায়গাগুলোকে বলা হয় মীকাত। এটা যেন এক ধরনের বিশেষ সীমা বা সীমানা যেখানে পৌঁছেই একজন মুসলিম বুঝে নেন, “এখন আমি আল্লাহর অতিথি, এখন থেকে আমার চলাফেরা, আচরণ সবই হবে এক নতুন নিয়মে।”  প্রিয় নবী মুহাম্মদ (সা.) নিজ হাতে এই মীকাতগুলো নির্ধারণ করে দিয়েছেন, যেন সবার জন্য বিষয়টি স্পষ্ট হয়। অঞ্চলভেদে মীকাত ভিন্ন হয়:

  • ধুল হুলাইফা (আবিয়ার আলী): মদিনা থেকে যাঁরা হজে যাচ্ছেন, তাদের জন্য এই স্থান। 
  • ইয়ালামলাম: ইয়েমেন দিক থেকে আগতদের জন্য নির্ধারিত। 
  • জুহফা: শাম (সিরিয়া, লেবানন, জর্ডান) ও মিসর থেকে আগতদের মীকাত। 
  • কারনুল মানাজিল: যারা নাজদের দিক থেকে আসছেন, তাদের জন্য এটি মীকাত।

 

আজকের দিনে যারা বিমানযোগে হজ বা উমরা করতে যাচ্ছেন, তাদেরও ইহরাম বাঁধতে হয় এই মীকাত পার হওয়ার আগেই  মানে প্লেনেই। অনেকেই তখন প্লেনে ওঠার আগে ইহরামের কাপড় পরে নেন, আর নিয়ত করেন আকাশে উড়ার পর মীকাতের কাছাকাছি গিয়ে। এই পুরো প্রক্রিয়াটি যেন একটা মানসিক প্রস্তুতি আমরা ধীরে ধীরে বিশ্বজগত থেকে সরে গিয়ে আল্লাহর সান্নিধ্যে প্রবেশ করতে যাচ্ছি। এটি কেবল একটা ভৌগলিক সীমা নয়, বরং এক আত্মিক দোরগোড়া।


পুরুষদের জন্য ইহরামের নিয়ম:

হজে যাওয়ার পথে পুরুষদের জন্য ইহরামের পোশাক একটু আলাদা,দেখতে সাদাসিধে, কোনো রঙ নেই, নেই কোনো অলংকার। কিন্তু এই দু’টুকরো কাপড়ে লুকিয়ে আছে এক গভীর আত্মিক সৌন্দর্য যা একজন মানুষকে আল্লাহর সবচেয়ে কাছাকাছি নিয়ে যায়। ইহরামের জন্য পুরুষেরা পরেন মাত্র দুটি সাদা কাপড় এই দু’টুকরো কাপড়ের মাঝেই লুকিয়ে থাকে বিনয়, আত্মসমর্পণ আর দুনিয়াবি পরিচয়ের ছেঁড়া গেরো।

  • ইজার: এটি কোমরের নিচের অংশ ঢাকার জন্য ব্যবহৃত হয়।
  • রিদা: এটি শরীরের উপরের অংশে জড়ানো হয়।

এই দুটি কাপড় হতে হবে সম্পূর্ণ সেলাইবিহীন মানে এতে বোতাম, গিঁট, কিংবা দর্জির ছাঁট থাকবে না। যেন দুনিয়ার কোনো সাজসজ্জা, কোনো পদ-পদবির পরিচয় সেখানে না থাকে। শুধুই এক বান্দা ও তার প্রভুর মাঝে নিখাদ সম্পর্ক।


ইহরাম বাঁধার আগে সুন্নত কাজগুলো: নিজের ভিতর ও বাহিরকে প্রস্তুত করা

ইহরামের আগে কিছু সুন্নত কাজ রয়েছে, যা হজের মানসিকতা গঠনে সাহায্য করে:

  • গোসল করা: যদি সম্ভব হয়, গোসল করে নিজেকে শুদ্ধ করে নেওয়া। 
  • সুগন্ধি ব্যবহার করা: তবে মনে রাখতে হবে, এটি ইহরামের আগে করতে হবে ইহরামের পর নয়। 
  • শরীরের অপ্রয়োজনীয় লোম পরিষ্কার ও নখ কাটা: যেহেতু আমরা যাচ্ছি আল্লাহর অতিথি হয়ে, তাই চেষ্টা করি যেন নিজেকে সবদিক থেকে পরিপাটি করে তুলি নখ কেটে, শরীর পরিচ্ছন্ন করে এমনভাবে প্রস্তুত হই, যেন সবচেয়ে সম্মানিত একজন মেহমানের মতো করে তাঁর সামনে হাজির হতে পারি।
  • দুই রাকাত সালাতুল ইহরাম: ইহরাম বাঁধার নিয়ত করে এ নামাজ আদায় করা যায় আল্লাহর কাছে এই যাত্রার বরকতের দোয়া হিসেবে। 

নিয়ত: একান্তভাবে আল্লাহর পথে যাত্রা

সব প্রস্তুতি শেষে ইহরামের কাপড় গায়ে, পবিত্র গোসল শেষে, সালাত আদায় করে যখন মানুষ একান্তভাবে দাঁড়ায় তখনই আসে সেই অত্যন্ত মূল্যবান মুহূর্ত। এ যেন হৃদয়ের গভীর থেকে উঠে আসা এক নীরব অঙ্গীকার। এই নিয়তই ইহরামের আত্মা এক গভীর, নির্ভেজাল সংকল্প, যেখানে একজন মানুষ আল্লাহর পথে নিজেকে পুরোপুরি সমর্পণ করে দেন।

 

এটা শুধু মুখে উচ্চারণ নয়, বরং এক গভীর অনুভূতির বহিঃপ্রকাশ যেখানে একজন মানুষ  বলে ওঠেন,

 “হে আমার প্রভু, আমি এসেছি। আমার এই সফর, এই ইচ্ছা, এই সমর্পণ সবকিছু শুধু তোমার জন্য।” নিয়তের দোয়া:


نَوَيْتُ الْحَجَّ وَأَحْرَمْتُ بِهِ لِلَّهِ تَعَالَى

 উচ্চারণ: নাওয়াইতুল হজ্জা ওয়া আহরামতু বিহি লিল্লাহি তা‘আলা

 অর্থ: আমি হজের নিয়ত করলাম এবং আল্লাহর উদ্দেশ্যে ইহরাম বাঁধলাম।


এরপর শুরু হয় তলবিয়াহ লাব্বাইকা আল্লাহুম্মা লাব্বাইক ।এটি যেন কোনো সাধারণ শব্দ নয়, বরং আত্মার গভীর থেকে উঠে আসা এক গোপন সাড়া। প্রতিটি উচ্চারণ যেন হৃদয়কে স্পর্শ করে, চোখে অশ্রু এনে দেয়।


হে আমার প্রভু, আমি হাজির, আমি এসেছি


এই আন্তরিক আহ্বান যেন বাতাসের সাথে মিশে যায়, চারদিকে ছড়িয়ে পড়ে আল্লাহর নিকট আমাদের গভীর ভালোবাসা আর তীব্র আকাঙ্ক্ষার ভাষা হয়ে ওঠে। 

এই মুহূর্ত থেকেই শুরু হয় এক নতুন জীবনের যাত্রা।


যখন একজন মানুষ দু’টি সাদা কাপড়ে মোড়া অবস্থায় তলবিয়াহ পাঠ করে পবিত্র ভূমির দিকে ধাপে ধাপে এগিয়ে যান, তখন তিনি আর সাধারণ কোনো যাত্রী থাকেন না। তিনি হয়ে ওঠেন আল্লাহর কাছে একজন সম্মানিত অতিথি একটি বিশেষ আমন্ত্রণের সাড়া দেওয়া, হৃদয়ভরে শ্রদ্ধার প্রতীক।

 

মহিলাদের জন্য ইহরামের নিয়ম:

পোশাক:

মহিলাদের জন্য ইহরামের কোনো নির্দিষ্ট পোশাক ঠিক করা নেই। তারা তাদের স্বাভাবিক পর্দাসম্মত পোশাকেই ইহরাম পালন করতে পারেন। তবে এখানে কিছু গুরুত্বপূর্ণ শর্ত রয়েছে পোশাকটি হবে ঢিলেঢালা, যাতে শরীরের আকার ফুটে না ওঠে। পাশাপাশি, পোশাকে থাকবে না কোনো অলংকার বা সুগন্ধি। পোশাকটি হবে সাধারণ ও আকর্ষণহীন, যেন আল্লাহর সামনে একান্ত বিনয় ও বিনম্রতা বজায় থাকে।

 

মুখ ঢাকা:

ইহরামের অবস্থায় মুখে কোনো কাপড় বা নেকাব পরা নিষিদ্ধ। তবে পুরুষদের সামনে পর্দা রক্ষার জন্য তাঁবুর কাপড় বা ওড়না ব্যবহার করে মুখ আংশিক ঢাকতে পারেন, তবে সেটা সরাসরি মুখে লাগানো যাবে না।


সুন্নত কাজগুলো:

পুরুষদের মতো মহিলারাও ইহরাম বাঁধার আগে গোসল করতে পারেন, নিজেদের শরীর পরিচ্ছন্ন করে নিতে পারেন এবং নিয়ত করে সালাতুল ইহরাম আদায় করতে পারেন। এটি তাদের আত্মাকে পরিশুদ্ধ করে, হজের পবিত্র যাত্রার জন্য মন ও দেহ প্রস্তুত করে তোলে।

 

নিয়ত:

হজ বা উমরার জন্য ইহরাম বাঁধার সময় প্রথমেই আল্লাহর উদ্দেশ্যে নিয়ত করতে হয়। নিয়ত পুরুষ মহিলা সবার জন্যই , বলা হয়:


 (নাওয়াইতুল হজ্জা ওয়া আহরামতু বিহি লিল্লাহি তা’আলা)

 অর্থ: আমি হজের নিয়ত করলাম এবং আল্লাহর জন্য ইহরাম বাঁধলাম।


এরপর উচ্চস্বরে তলবিয়াহ পড়তে হয়:


 (লাব্বাইকা আল্লাহুম্মা লাব্বাইক...)

 অর্থ: “হে আল্লাহ, আমি হাজির। আপনার কোনো শরিক নেই।” নারীরা নীরব বা স্বল্পস্বরে তলবিয়াহ পাঠ করবেন।

 

ইহরাম অবস্থায় নিষিদ্ধ কাজগুলো:

ইহরাম বাঁধার পর কিছু কার্যকলাপ নিষিদ্ধ হয়ে যায়, যেগুলোর মধ্যে কিছু সাধারণভাবে উভয়ের জন্য প্রযোজ্য এবং কিছু নির্দিষ্টভাবে পুরুষ বা মহিলার জন্য।


উভয়ের জন্য নিষিদ্ধ:

  • চুল বা দাড়ি কাটা 
  • নখ কাটা 
  • সুগন্ধি ব্যবহার 
  • শিকার করা বা শিকারীকে সহায়তা করা 
  • ঝগড়া-বিবাদ, অশ্লীল বাক্য ব্যবহার 
  • যৌনসংগম বা এর উদ্দেশ্যে কোনো আচরণ 

পুরুষদের জন্য অতিরিক্ত নিষেধ:

  • সেলাই করা কাপড় পরা 
  • মাথা ঢেকে রাখা (যেমন - টুপি, পাগড়ি, চাদর) 

মহিলাদের জন্য অতিরিক্ত নিষেধ:

মুখে কাপড় লাগানো বা নেকাব পরা (সরাসরি মুখে স্পর্শ করে এমনভাবে)

 

বিশেষ পরিস্থিতিতে করণীয়:

ঋতুবতী নারীরাও ইহরাম বাঁধতে পারেন, তবে তাদের জন্য সালাত আদায় করা নিষেধ থাকে যতক্ষণ না তারা পুনরায় পবিত্র হন। এই সময়টা হয়তো একটু ধৈর্যের পরীক্ষা, কিন্তু আল্লাহর কাছে তাদের ইবাদত অমূল্য এবং এই অবস্থায়ও তারা তাঁর কাছ থেকে রহমত ও গুনাহ ক্ষমা প্রার্থনা করতে পারেন।

 

হজ বা উমরার সময় নির্ধারিত নিয়মকানুন অনুসরণ করা অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ। যদি কেউ ইহরামের শর্ত বা অন্যান্য নিয়ম ভঙ্গ করেন, তাহলে তার জন্য ‘দাম’ অর্থাৎ একটি পশু কুরবানি করা ফরজ হতে পারে। দাম হল সেই ধরনের তওবা ও খোদার কাছে ক্ষমা প্রার্থনার মাধ্যম, যা বাধ্যতামূলক হয় নিয়ম ভঙ্গের কারণে। এটি একজন হাজীর দায়িত্ব ও সদিচ্ছার প্রতীক, যাতে সে নিজের ভুল থেকে শিক্ষা নিয়ে পরবর্তীবার আরো সতর্ক ও নিষ্ঠার সঙ্গে হজ পালন করতে পারে।


ইহরামের কিছু সুন্নত আমল:

  • বারবার তলবিয়াহ পাঠ করা 
  • কুরআন তিলাওয়াত 
  • দোয়া করা 
  • জিকির ও ইস্তিগফার করা 

ইহরাম বাঁধা শুধুমাত্র পোশাক বদলের নাম নয় এটা একটি গভীর আত্মিক পরিবর্তন, যেখানে মানুষ নিজেকে সম্পূর্ণরূপে আল্লাহর নিকট নিবেদন করে। সঠিক নিয়ম ও নিয়ত ছাড়া ইহরাম অসম্পূর্ণ, আর এটাই হজের প্রথম ধাপ। ভুল হলে পুরো হজের ইবাদতই প্রভাবিত হতে পারে। তাই পুরুষ-মহিলাদের উচিত ইহরামের নিয়মকানুন ও দোয়া ভালোভাবে জেনে হৃদয় থেকে পালন করা। আল্লাহ তায়ালা আমাদের সবাইকে সুন্দর ও সঠিকভাবে হজ পালন করার তাওফিক দান করুন, আমিন।



Share
Comments
কমেন্ট করতে লগইন করুন। লগইন | রেজিস্ট্রেশন

No Data Found
Cart

Cart is empty