হজ ইসলামের পাঁচটি স্তম্ভের মধ্যে পঞ্চম হলেও প্রতিটি মুসলিমের হৃদয়ে এর মর্যাদা অনেক উঁচুতে। এটি এমন একটি ইবাদত, যার জন্য আমরা জীবনের বহুদিন ধরে স্বপ্ন দেখি, দোয়া করি, প্রস্তুতি নিই। আর যখন সেই কাঙ্ক্ষিত সফরের সময় আসে, তখন যাত্রার প্রথম ধাপ হয় ইহরাম । ইহরাম শুধুমাত্র দুটি সাদা কাপড় নয় এটি এক ধরনের মানসিক ও আত্মিক প্রস্তুতি। একটি বিশেষ অবস্থায় প্রবেশ, যেখানে দুনিয়ার সব চাওয়া-পাওয়া, ব্যস্ততা ও অহংবোধ ঝেড়ে ফেলে একজন মানুষ সম্পূর্ণভাবে আল্লাহর পথে নিজেকে সঁপে দেয়।
এই পর্বে রয়েছে কিছু নির্দিষ্ট নিয়ম, করণীয় ও নিষেধাজ্ঞা যা নারী ও পুরুষের ক্ষেত্রে কিছুটা ভিন্ন হতে পারে। এই লেখায় আমরা সহজভাবে জানবো, ইহরাম কীভাবে বাঁধতে হয়, কী দোয়া পড়তে হয়, কী কী বিষয় থেকে বিরত থাকতে হয় যাতে আমাদের হজের যাত্রা হয় সঠিক, সুন্দর ও আল্লাহর সন্তুষ্টির উপযুক্ত।
‘ইহরাম’ শব্দটি এসেছে আরবী "হারাম" শব্দ থেকে, যার অর্থ কিছু জিনিসকে নিজের ওপর নিষিদ্ধ করা। হজ বা উমরার সময় যখন একজন মুসলিম ইহরাম অবস্থায় প্রবেশ করেন, তখন এমন অনেক কাজ, যা সাধারণ সময় একেবারেই বৈধ তা তখন নিষিদ্ধ হয়ে যায়। যেমন: চুল কাটা, নখ ছাঁটা, সুগন্ধি ব্যবহার, এমনকি শিকার করাও। আসলে, ইহরাম মানেই শুধু পোশাকের পরিবর্তন নয় এটি একটা অন্তরের অবস্থাও। এটি এমন এক ঘোষণা, যেখানে একজন মানুষ বলেন: “আমি এখন আল্লাহর অতিথি, আমি দুনিয়ার সব সাজগোজ, আরাম-আয়েশ কিছু সময়ের জন্য ছেড়ে দিয়েছি, শুধু তাঁর সন্তুষ্টির জন্য।”এই সময়টা যেন এক ধরনের সংযমের অনুশীলন, নিজের ভেতরের আত্মাকে পরিশুদ্ধ করার একটি সুযোগ।
হজ বা উমরার পথে বের হলে, একটা নির্দিষ্ট জায়গা পর্যন্ত পৌঁছানোর আগেই আমাদের ইহরাম বাঁধা বাধ্যতামূলক। সেই নির্দিষ্ট সীমা বা জায়গাগুলোকে বলা হয় মীকাত। এটা যেন এক ধরনের বিশেষ সীমা বা সীমানা যেখানে পৌঁছেই একজন মুসলিম বুঝে নেন, “এখন আমি আল্লাহর অতিথি, এখন থেকে আমার চলাফেরা, আচরণ সবই হবে এক নতুন নিয়মে।” প্রিয় নবী মুহাম্মদ (সা.) নিজ হাতে এই মীকাতগুলো নির্ধারণ করে দিয়েছেন, যেন সবার জন্য বিষয়টি স্পষ্ট হয়। অঞ্চলভেদে মীকাত ভিন্ন হয়:
আজকের দিনে যারা বিমানযোগে হজ বা উমরা করতে যাচ্ছেন, তাদেরও ইহরাম বাঁধতে হয় এই মীকাত পার হওয়ার আগেই মানে প্লেনেই। অনেকেই তখন প্লেনে ওঠার আগে ইহরামের কাপড় পরে নেন, আর নিয়ত করেন আকাশে উড়ার পর মীকাতের কাছাকাছি গিয়ে। এই পুরো প্রক্রিয়াটি যেন একটা মানসিক প্রস্তুতি আমরা ধীরে ধীরে বিশ্বজগত থেকে সরে গিয়ে আল্লাহর সান্নিধ্যে প্রবেশ করতে যাচ্ছি। এটি কেবল একটা ভৌগলিক সীমা নয়, বরং এক আত্মিক দোরগোড়া।
হজে যাওয়ার পথে পুরুষদের জন্য ইহরামের পোশাক একটু আলাদা,দেখতে সাদাসিধে, কোনো রঙ নেই, নেই কোনো অলংকার। কিন্তু এই দু’টুকরো কাপড়ে লুকিয়ে আছে এক গভীর আত্মিক সৌন্দর্য যা একজন মানুষকে আল্লাহর সবচেয়ে কাছাকাছি নিয়ে যায়। ইহরামের জন্য পুরুষেরা পরেন মাত্র দুটি সাদা কাপড় এই দু’টুকরো কাপড়ের মাঝেই লুকিয়ে থাকে বিনয়, আত্মসমর্পণ আর দুনিয়াবি পরিচয়ের ছেঁড়া গেরো।
এই দুটি কাপড় হতে হবে সম্পূর্ণ সেলাইবিহীন মানে এতে বোতাম, গিঁট, কিংবা দর্জির ছাঁট থাকবে না। যেন দুনিয়ার কোনো সাজসজ্জা, কোনো পদ-পদবির পরিচয় সেখানে না থাকে। শুধুই এক বান্দা ও তার প্রভুর মাঝে নিখাদ সম্পর্ক।
ইহরামের আগে কিছু সুন্নত কাজ রয়েছে, যা হজের মানসিকতা গঠনে সাহায্য করে:
সব প্রস্তুতি শেষে ইহরামের কাপড় গায়ে, পবিত্র গোসল শেষে, সালাত আদায় করে যখন মানুষ একান্তভাবে দাঁড়ায় তখনই আসে সেই অত্যন্ত মূল্যবান মুহূর্ত। এ যেন হৃদয়ের গভীর থেকে উঠে আসা এক নীরব অঙ্গীকার। এই নিয়তই ইহরামের আত্মা এক গভীর, নির্ভেজাল সংকল্প, যেখানে একজন মানুষ আল্লাহর পথে নিজেকে পুরোপুরি সমর্পণ করে দেন।
এটা শুধু মুখে উচ্চারণ নয়, বরং এক গভীর অনুভূতির বহিঃপ্রকাশ যেখানে একজন মানুষ বলে ওঠেন,
“হে আমার প্রভু, আমি এসেছি। আমার এই সফর, এই ইচ্ছা, এই সমর্পণ সবকিছু শুধু তোমার জন্য।” নিয়তের দোয়া:
نَوَيْتُ الْحَجَّ وَأَحْرَمْتُ بِهِ لِلَّهِ تَعَالَى
উচ্চারণ: নাওয়াইতুল হজ্জা ওয়া আহরামতু বিহি লিল্লাহি তা‘আলা
অর্থ: আমি হজের নিয়ত করলাম এবং আল্লাহর উদ্দেশ্যে ইহরাম বাঁধলাম।
এরপর শুরু হয় তলবিয়াহ লাব্বাইকা আল্লাহুম্মা লাব্বাইক ।এটি যেন কোনো সাধারণ শব্দ নয়, বরং আত্মার গভীর থেকে উঠে আসা এক গোপন সাড়া। প্রতিটি উচ্চারণ যেন হৃদয়কে স্পর্শ করে, চোখে অশ্রু এনে দেয়।
“হে আমার প্রভু, আমি হাজির, আমি এসেছি”
এই আন্তরিক আহ্বান যেন বাতাসের সাথে মিশে যায়, চারদিকে ছড়িয়ে পড়ে আল্লাহর নিকট আমাদের গভীর ভালোবাসা আর তীব্র আকাঙ্ক্ষার ভাষা হয়ে ওঠে।
এই মুহূর্ত থেকেই শুরু হয় এক নতুন জীবনের যাত্রা।
যখন একজন মানুষ দু’টি সাদা কাপড়ে মোড়া অবস্থায় তলবিয়াহ পাঠ করে পবিত্র ভূমির দিকে ধাপে ধাপে এগিয়ে যান, তখন তিনি আর সাধারণ কোনো যাত্রী থাকেন না। তিনি হয়ে ওঠেন আল্লাহর কাছে একজন সম্মানিত অতিথি একটি বিশেষ আমন্ত্রণের সাড়া দেওয়া, হৃদয়ভরে শ্রদ্ধার প্রতীক।
মহিলাদের জন্য ইহরামের কোনো নির্দিষ্ট পোশাক ঠিক করা নেই। তারা তাদের স্বাভাবিক পর্দাসম্মত পোশাকেই ইহরাম পালন করতে পারেন। তবে এখানে কিছু গুরুত্বপূর্ণ শর্ত রয়েছে পোশাকটি হবে ঢিলেঢালা, যাতে শরীরের আকার ফুটে না ওঠে। পাশাপাশি, পোশাকে থাকবে না কোনো অলংকার বা সুগন্ধি। পোশাকটি হবে সাধারণ ও আকর্ষণহীন, যেন আল্লাহর সামনে একান্ত বিনয় ও বিনম্রতা বজায় থাকে।
ইহরামের অবস্থায় মুখে কোনো কাপড় বা নেকাব পরা নিষিদ্ধ। তবে পুরুষদের সামনে পর্দা রক্ষার জন্য তাঁবুর কাপড় বা ওড়না ব্যবহার করে মুখ আংশিক ঢাকতে পারেন, তবে সেটা সরাসরি মুখে লাগানো যাবে না।
পুরুষদের মতো মহিলারাও ইহরাম বাঁধার আগে গোসল করতে পারেন, নিজেদের শরীর পরিচ্ছন্ন করে নিতে পারেন এবং নিয়ত করে সালাতুল ইহরাম আদায় করতে পারেন। এটি তাদের আত্মাকে পরিশুদ্ধ করে, হজের পবিত্র যাত্রার জন্য মন ও দেহ প্রস্তুত করে তোলে।
নিয়ত:
হজ বা উমরার জন্য ইহরাম বাঁধার সময় প্রথমেই আল্লাহর উদ্দেশ্যে নিয়ত করতে হয়। নিয়ত পুরুষ মহিলা সবার জন্যই , বলা হয়:
(নাওয়াইতুল হজ্জা ওয়া আহরামতু বিহি লিল্লাহি তা’আলা)
অর্থ: আমি হজের নিয়ত করলাম এবং আল্লাহর জন্য ইহরাম বাঁধলাম।
এরপর উচ্চস্বরে তলবিয়াহ পড়তে হয়:
(লাব্বাইকা আল্লাহুম্মা লাব্বাইক...)
অর্থ: “হে আল্লাহ, আমি হাজির। আপনার কোনো শরিক নেই।” নারীরা নীরব বা স্বল্পস্বরে তলবিয়াহ পাঠ করবেন।
ইহরাম বাঁধার পর কিছু কার্যকলাপ নিষিদ্ধ হয়ে যায়, যেগুলোর মধ্যে কিছু সাধারণভাবে উভয়ের জন্য প্রযোজ্য এবং কিছু নির্দিষ্টভাবে পুরুষ বা মহিলার জন্য।
মুখে কাপড় লাগানো বা নেকাব পরা (সরাসরি মুখে স্পর্শ করে এমনভাবে)
ঋতুবতী নারীরাও ইহরাম বাঁধতে পারেন, তবে তাদের জন্য সালাত আদায় করা নিষেধ থাকে যতক্ষণ না তারা পুনরায় পবিত্র হন। এই সময়টা হয়তো একটু ধৈর্যের পরীক্ষা, কিন্তু আল্লাহর কাছে তাদের ইবাদত অমূল্য এবং এই অবস্থায়ও তারা তাঁর কাছ থেকে রহমত ও গুনাহ ক্ষমা প্রার্থনা করতে পারেন।
হজ বা উমরার সময় নির্ধারিত নিয়মকানুন অনুসরণ করা অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ। যদি কেউ ইহরামের শর্ত বা অন্যান্য নিয়ম ভঙ্গ করেন, তাহলে তার জন্য ‘দাম’ অর্থাৎ একটি পশু কুরবানি করা ফরজ হতে পারে। দাম হল সেই ধরনের তওবা ও খোদার কাছে ক্ষমা প্রার্থনার মাধ্যম, যা বাধ্যতামূলক হয় নিয়ম ভঙ্গের কারণে। এটি একজন হাজীর দায়িত্ব ও সদিচ্ছার প্রতীক, যাতে সে নিজের ভুল থেকে শিক্ষা নিয়ে পরবর্তীবার আরো সতর্ক ও নিষ্ঠার সঙ্গে হজ পালন করতে পারে।
ইহরাম বাঁধা শুধুমাত্র পোশাক বদলের নাম নয় এটা একটি গভীর আত্মিক পরিবর্তন, যেখানে মানুষ নিজেকে সম্পূর্ণরূপে আল্লাহর নিকট নিবেদন করে। সঠিক নিয়ম ও নিয়ত ছাড়া ইহরাম অসম্পূর্ণ, আর এটাই হজের প্রথম ধাপ। ভুল হলে পুরো হজের ইবাদতই প্রভাবিত হতে পারে। তাই পুরুষ-মহিলাদের উচিত ইহরামের নিয়মকানুন ও দোয়া ভালোভাবে জেনে হৃদয় থেকে পালন করা। আল্লাহ তায়ালা আমাদের সবাইকে সুন্দর ও সঠিকভাবে হজ পালন করার তাওফিক দান করুন, আমিন।
Cart is empty