মুসলমানদের জীবনের অন্যতম কাঙ্ক্ষিত ইবাদত হলো হজ ও ওমরাহ পালন করা। এই ইবাদতের সঙ্গে যুক্ত রয়েছে ভ্রমণ, পরিকল্পনা, খরচ এবং মানসিক প্রস্তুতি। হজ বা ওমরাহ পালন করতে গেলে সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ প্রস্তুতিগুলোর একটি হলো থাকা-খাওয়ার সুষ্ঠু ব্যবস্থা করা।যেহেতু হজ বা ওমরাহ করতে গিয়ে মুসলমানরা অধিকাংশ সময় কাটান ইবাদত, নামাজ, দোয়া ও জিকিরে, তাই থাকার জায়গার মান আরামদায়ক ও সহায়ক হওয়া অপরিহার্য।
এই ব্লগে আমরা আলোচনা করব কীভাবে আপনি মক্কা ও মদিনায় সহজে, সাশ্রয়ী ও মানসম্পন্ন হোটেল খুঁজে পেতে পারেন। বিশেষ করে যারা বাংলাদেশ থেকে যাচ্ছেন, তাদের জন্য এটি একটি বাস্তবধর্মী ও কার্যকরী গাইড হবে।
ভ্রমণের ক্ষেত্রে আগে থেকে পরিকল্পনা করা সব সময়ই বুদ্ধিমানের কাজ। কিন্তু মক্কা ও মদিনার মতো ভ্রমণের জন্য এই পরিকল্পনা আরও বেশি জরুরি।
প্রতিবছর প্রায় ২ কোটির বেশি মুসলমান হজ ও ওমরাহ পালন করতে সৌদি আরবে যান। এর মধ্যে একটি বিশাল অংশ মক্কা ও মদিনায় অবস্থান করেন বিভিন্ন সময়ে। এই বিপুল সংখ্যক মানুষকে আবাসনের জন্য সৌদি সরকার ও বেসরকারি হোটেল কর্তৃপক্ষ পর্যাপ্ত প্রস্তুতি রাখে, কিন্তু চাহিদা যেহেতু প্রতিনিয়ত বাড়ছে, তাই ভালো হোটেল পেতে প্রতিযোগিতাও তীব্র।
মক্কা ও মদিনায় বিভিন্ন ধরনের হোটেল পাওয়া যায় বিশ্বখ্যাত ফাইভ স্টার হোটেল থেকে শুরু করে সাধারণ টু কিংবা থ্রি স্টারর ছোট হোটেল পর্যন্ত। হোটেলগুলোর মূল্য নির্ভর করে অবস্থান (লোকেশন), সুবিধা, মৌসুম এবং বুকিং সময়ের ওপর। আপনি যদি সময় মতো পরিকল্পনা করেন, তবে সহজেই ভালো হোটেল খুঁজে পেতে পারেন।
সাধারণত হজ মৌসুম (জিলহজ মাস) এবং রমজান মাসে মক্কা ও মদিনায় বিপুল ভিড় থাকে। এই সময়ে ভালো হোটেল পাওয়া যেমন কঠিন, তেমনি দামও দ্বিগুণ বা তার চেয়েও বেশি হয়ে যায়। বিশেষ করে ২০ থেকে ২৯ রমজান এবং আরাফার দিনের আগের সপ্তাহে হোটেলের দামে ব্যাপক বৃদ্ধি দেখা যায়।
যদি আপনি এই সময়ে যাওয়ার পরিকল্পনা করেন, তাহলে অন্তত ৬ মাস আগে হোটেল বুকিং করুন। অনেক হোটেল আগে থেকে বুকিং নেওয়ার সুবিধা দেয়, এবং কিছু ক্ষেত্রে ‘Free Cancalation’ সুবিধাও পাওয়া যায়।
যারা হজ মৌসুমের বাইরের সময় (জানুয়ারি–মার্চ বা সেপ্টেম্বর–নভেম্বর) ওমরাহ করতে যান, তারা অনেক কম খরচে মানসম্মত হোটেল পেতে পারেন। অফ-সিজনে হোটেল খালি থাকে, এবং অফার বা ডিসকাউন্ট পাওয়ার সম্ভাবনাও বেশি থাকে।
মক্কা ও মদিনা সফরের সময় সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ এবং চ্যালেঞ্জিং বিষয়গুলোর একটি হলো হোটেল নির্বাচন। অনেকেই ভিসা ও টিকিট পাওয়ার পর দুশ্চিন্তায় পড়েন, কোথায় থাকবেন, কীভাবে মসজিদে সহজে যাওয়া যাবে, বা সাশ্রয়ী খরচে ভালো মানের হোটেল কোথায় পাওয়া যাবে।
হোটেল বুকিংয়ের ক্ষেত্রে সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ বিষয় হলো লোকেশন, অর্থাৎ কোথায় হোটেলটি অবস্থিত। কারণ মক্কা ও মদিনার হোটেল মান, মূল্য ও যাতায়াতের সুবিধা সম্পূর্ণ নির্ভর করে এর অবস্থানের উপর। আপনার মূল উদ্দেশ্য যেহেতু নামাজ, তাওয়াফ এবং মহানবী (সা.)-এর রওজা মোবারক জিয়ারত করা, তাই এমন জায়গায় হোটেল নির্বাচন করাই শ্রেয়, যেখান থেকে এসব কাজ সহজে করা যায়।
এই এলাকায় সাধারণত হোটেলগুলো ২০০ থেকে ৫০০ মিটারের মধ্যে অবস্থিত থাকে। পায়ে হেঁটে সহজেই মসজিদে যাওয়া যায়। অনেক হোটেলেই হারামের ভিউ পাওয়া যায়, তবে এর জন্য অতিরিক্ত খরচ লাগতে পারে।
সুবিধাসমূহ:
অসুবিধাসমূহ:
মক্কার আরেকটি জনপ্রিয় এলাকা হলো আজিজিয়া, যা হারাম থেকে প্রায় ৪–৫ কিমি দূরে অবস্থিত। এই এলাকায় সাধারণত মধ্যম বা কম বাজেটের হোটেল পাওয়া যায় এবং বেশিরভাগ হোটেল কর্তৃপক্ষ নিজস্ব বাস সার্ভিস বা শাটল সার্ভিস দিয়ে থাকে যা নির্দিষ্ট সময়ে হারামে ছেড়ে আসে।
সুবিধাসমূহ:
অসুবিধাসমূহ:
এই এলাকাগুলো তুলনামূলক পুরোনো এবং কিছুটা বাজেট-বান্ধব। স্থানীয় বাস বা হেঁটে হারামে পৌঁছানো যায়, তবে সময় লাগে। যাদের বাজেট সীমিত এবং হারামে একাধিকবার যাওয়ার পরিকল্পনা নেই, তারা এই ধরনের এলাকা বিবেচনা করতে পারেন।
মদিনা সফরের অন্যতম গুরুত্বপূর্ণ বিষয় হলো মসজিদে নববী এবং মহানবী হযরত মুহাম্মদ (সা.)-এর রওজা মোবারক জিয়ারত। যেহেতু মসজিদের ভেতরে পুরুষ ও নারীদের প্রবেশদ্বার আলাদা, তাই হোটেল নির্বাচনেও সেই অনুযায়ী ভিন্নতা থাকতে পারে।
পুরুষদের নামাজের প্রধান গেটগুলো এই পাশে হওয়ায়, যদি পুরুষ সদস্যদের ইবাদতের ওপর ফোকাস থাকে, তাহলে মসজিদের উত্তর পাশে থাকা সবচেয়ে সুবিধাজনক। পায়ে হেঁটে মাত্র ২–৩ মিনিটেই মসজিদে পৌঁছানো যায়।
সুবিধাসমূহ:
নারীদের প্রবেশের জন্য মসজিদের দক্ষিণ-পূর্ব দিকে নির্দিষ্ট গেট থাকে। নারীদের হোটেল অবস্থান এই পাশে হলে তারা নির্ধারিত সময়ে সহজে মসজিদে প্রবেশ করতে পারেন।
সুবিধাসমূহ:
বর্তমানে আপনি ঘরে বসেই মক্কা ও মদিনার যেকোনো হোটেল অনলাইনে বুক করতে পারেন। এই সাইটগুলো ব্যবহার করলে আপনি সহজেই বিভিন্ন হোটেলের মূল্য, সুবিধা, রেটিং ও রিভিউ তুলনা করে নিতে পারেন।
মক্কা ও মদিনা সফরের সময় হোটেল নির্বাচন শুধুমাত্র অবস্থানের উপরই নির্ভর করে না এটি নির্ভর করে আপনার সফরের ধরন, সঙ্গীদের সংখ্যা, শারীরিক অবস্থা, এবং অবশ্যই বাজেটের উপর। একজন একক যাত্রীর জন্য যেটা আদর্শ, সেটা পরিবার বা বয়স্ক কারও জন্য একেবারেই অনুপযুক্ত হতে পারে।
তাই হোটেল নির্বাচন করার আগে আপনাকে অবশ্যই বুঝতে হবে আপনি কেমন ধরনের ভ্রমণকারী, এবং আপনার প্রয়োজনীয়তা ও সীমাবদ্ধতা কী। এই অংশে আমরা তিন ধরনের ভ্রমণকারীর জন্য আলাদা আলাদা কৌশল বিশ্লেষণ করব: একক, পরিবারসহ, এবং বয়স্ক বা শারীরিকভাবে অসুস্থ যাত্রীরা।
যারা একা মক্কা বা মদিনায় যাচ্ছেন তাদের জন্য হোটেল নির্বাচন অনেকটা সহজ এবং বাজেটফ্রেন্ডলি হয়। একজন একক যাত্রীর মূল লক্ষ্য থাকে ইবাদত, তাওয়াফ, নামাজ, আর নিজের আত্মিক উন্নতি। এজন্য বিলাসবহুল সুযোগ-সুবিধার চেয়ে প্রয়োজনীয় এবং কার্যকর সুবিধাই বেশি জরুরি।
বাজেট পরামর্শ:
প্রতিদিন ১৫০ থেকে ৩০০ সৌদি রিয়াল বাজেট রাখলে একজন একক ভ্রমণকারী বেশ মানসম্মত হোটেল পেতে পারেন। হোটেলের অবস্থান ও সিজন অনুযায়ী দাম কমবেশি হতে পারে। বিশেষ করে হজ বা রমজানে এই দাম অনেক বেড়ে যায়।
পরিবার নিয়ে হজ বা ওমরাহ করতে গেলে হোটেল নির্বাচন অনেক বেশি পরিকল্পনা ও সচেতনতার বিষয়। ছোট বাচ্চা, নারী সদস্য, এবং পরিবারের অন্যান্য সদস্যদের আরাম ও নিরাপত্তা নিশ্চিত করতে হলে আপনাকে দেখতে হবে যে হোটেলটি কত বড়, কী ধরনের সেবা দেয়, রান্নার সুবিধা আছে কিনা, এবং লোকেশন কতটা সুবিধাজনক।
রুম টাইপ বেছে নেয়ার কৌশল:
বাজেট কৌশল:
পরিবার নিয়ে গেলে মাথাপিছু খরচ কম হলেও মোট খরচ বেড়ে যায়। স্যুট বা অ্যাপার্টমেন্ট স্টাইল রুমের জন্য প্রতিদিন ৩৫০–৭০০ রিয়াল পর্যন্ত লাগতে পারে, অবস্থান ও সিজনের উপর ভিত্তি করে। তবে রান্নার ব্যবস্থা থাকলে খাবার বাবদ খরচ অনেকটা সাশ্রয়ী হয়।
যাদের বয়স বেশি, হাঁটার অসুবিধা আছে, বা শারীরিকভাবে দুর্বল তাদের জন্য হোটেলের মান ও অবস্থান সবচেয়ে বড় বিষয়। যতই দাম বেশি হোক না কেন, হারামের বা মসজিদে নববীর যত কাছে থাকা যায়, ততই ভালো।
কী ধরনের সুবিধা দরকার?
বাজেট ও পরিকল্পনা:
এই ধরনের যাত্রীর জন্য প্রতিদিন ৩০০–৬০০ রিয়াল বাজেট রাখলে ভালো মানের, সুবিধাজনক হোটেল পাওয়া যায়। হজের মৌসুমে দাম আরও বাড়ে, তাই অগ্রিম বুকিং করাই শ্রেয়।
সবাই প্রযুক্তি বা ইংরেজি ওয়েবসাইটে দক্ষ না-ও হতে পারেন। সেক্ষেত্রে একটি বিশ্বস্ত বাংলাদেশি ট্রাভেল এজেন্সির সাহায্য নেওয়া অনেক সহজ উপায় হতে পারে। এই এজেন্সিগুলো হজ/ওমরাহ প্যাকেজ অফার করে, যার মধ্যে হোটেল, যাতায়াত, গাইড ও খাবারও থাকতে পারে।
মক্কা ও মদিনায় ভালো হোটেল খোঁজা কঠিন কিছু নয়, যদি আপনি আগে থেকে কিছু গবেষণা করেন এবং পরিকল্পিতভাবে সিদ্ধান্ত নেন। আপনার ইবাদতের পরিবেশ যাতে আরামদায়ক ও মানসিকভাবে প্রশান্তিদায়ক হয়, সেজন্য হোটেল নির্বাচন একটি গুরুত্বপূর্ণ ধাপ। আপনি চাইলে অনলাইনে নিজেই হোটেল বুক করতে পারেন অথবা একটি বিশ্বস্ত এজেন্সির সাহায্য নিতে পারেন।
পরিকল্পনা, সময় নির্বাচন, সঠিক লোকেশন এবং অনলাইন রিভিউ আপনার হোটেল নির্বাচনকে সহজ করে তুলবে।