ব্লগ

ইসলামের গুরুত্বপূর্ণ শিক্ষা, সঠিক নিয়ম-কানুন এবং ভ্রমণের জন্য প্রয়োজনীয় প্রস্তুতির সাথে সাথে বিভিন্ন পবিত্র স্থানের ইতিহাস ও দর্শনীয় স্থানসমূহের বিস্তারিত বর্ণনা থাকবে এখানে।

Blog Details
হজ্জে ফরজ, সুন্নত ও ওয়াজিব: প্রতিটি নিয়মের ব্যাখ্যা

হজ্জ ইসলামের পঞ্চম স্তম্ভ এবং প্রতিটি সামর্থ্যবান মুসলিমের জন্য জীবনে একবার এই ইবাদত পালন করা ফরজ। এটি আল্লাহ তা‘আলার প্রতি ভক্তি, আনুগত্য এবং ত্যাগের প্রতীক। হজ্জের নিয়মাবলী তিনটি প্রধান শ্রেণিতে বিভক্ত: ফরজ, ওয়াজিব এবং সুন্নত।


ফরজ হলো হজ্জের মূল ভিত্তি, যা না করলে হজ্জ বাতিল হয়ে যায়। ওয়াজিব হলো অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ কাজ, যা বাদ দিলে দম (কোরবানি) দিতে হয়। সুন্নত হলো রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামের অনুসৃত কাজ, যা পালন করলে অতিরিক্ত সওয়াব অর্জিত হয়।


এই প্রবন্ধে আমরা হজ্জের ফরজ, ওয়াজিব এবং সুন্নতের বিস্তারিত ব্যাখ্যা প্রদান করব, যাতে হাজীগণ এই ইবাদত সঠিকভাবে সম্পন্ন করতে পারেন।


হজ্জের ফরজ

হজ্জের ফরজ হলো এমন কাজ, যা অবশ্যই পালন করতে হয়। এগুলো হজ্জের মূল স্তম্ভ এবং এর মধ্যে একটিও বাদ পড়লে হজ্জ পূর্ণ হয় না। হজ্জের ফরজ তিনটি: ইহরাম, আরাফাতে অবস্থান, এবং তাওয়াফে যিয়ারত।


ইহরাম

ইহরাম হজ্জের প্রথম এবং অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ ফরজ। এটি হজ্জ বা উমরাহর নিয়ত করার মাধ্যমে শুরু হয়, যার সাথে বিশেষ পোশাক পরিধান করা হয়। পুরুষদের জন্য ইহরামের পোশাক হলো দুটি সাদা কাপড়ের টুকরো: একটি কোমরে (ইজার) এবং অন্যটি কাঁধের উপর (রিদা)। এই পোশাক সেলাইবিহীন এবং সরলতার প্রতীক। মহিলারা তাদের স্বাভাবিক শালীন পোশাক পরতে পারেন, তবে তা অবশ্যই পর্দার নিয়ম মেনে হতে হবে।


ইহরাম বাঁধার জন্য মীকাত নামক নির্দিষ্ট স্থানে পৌঁছে নিয়ত করতে হয়। মীকাত হলো মক্কার চারপাশে নির্ধারিত সীমানা, যেমন: জুল-হুলাইফা, যাবালে আলী, কারনুল মানাযিল ইত্যাদি। মীকাত অতিক্রম করার আগে ইহরাম বাঁধা বাধ্যতামূলক। নিয়ত করার সময় প্রথমে দুই রাক‘আত নফল নামায পড়া হয়, তারপর হাজী নিম্নলিখিত দো‘আ পড়েন:


লাব্বাইক আল্লাহুম্মা বিহাজ্জিন (হে আল্লাহ! আমি হজ্জের জন্য হাযির)।


ইহরামের পর হাজী কিছু নিষিদ্ধ কাজ থেকে বিরত থাকেন। এর মধ্যে রয়েছে:

  • চুল বা নখ কাটা।
  • সুগন্ধি ব্যবহার করা।
  • শিকার করা বা প্রাণী হত্যা করা।
  • স্বামী-স্ত্রীর মধ্যে শারীরিক সম্পর্ক বা এ সম্পর্কিত কথাবার্তা।
  • ঝগড়া, গালিগালাজ বা অশ্লীল কথাবার্তা।

ইহরামের মাধ্যমে হাজী শারীরিক ও আধ্যাত্মিকভাবে পবিত্রতা অর্জন করেন এবং হজ্জের জন্য নিজেকে প্রস্তুত করেন। এটি হজ্জের প্রথম ধাপ এবং এর মাধ্যমে হাজী আল্লাহর ডাকে সাড়া দেন।


আরাফাতে অবস্থান

আরাফাতে অবস্থান হজ্জের সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ ফরজ এবং এটিকে হজ্জের মূল ভিত্তি বলা হয়। ৯ই জিলহজ্জ দুপুর (জোহরের সময়) থেকে সূর্যাস্ত পর্যন্ত আরাফাতের ময়দানে অবস্থান করতে হয়। এই সময় হাজীগণ আল্লাহর কাছে দো‘আ, তওবা, এবং ক্ষমা প্রার্থনা করেন। রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম বলেছেন:


হজ্জ হলো আরাফাত।


আরাফাতের ময়দানে হাজীগণ জোহর ও আসরের নামায একসাথে আদায় করেন, যা কসর (সংক্ষিপ্ত) আকারে পড়া হয়। এরপর তারা সারা দিন আল্লাহর জিকির, কুরআন তিলাওয়াত এবং দো‘আয় মগ্ন থাকেন। আরাফাতে অবস্থানের সময় হাজীগণ নিজেদের গুনাহের জন্য তওবা করেন এবং আল্লাহর রহমত কামনা করেন। এই সময়টি হজ্জের আধ্যাত্মিক উচ্চতার শীর্ষ মুহূর্ত। আরাফাতে অবস্থান না করলে হজ্জ পূর্ণ হয় না, তাই এটি অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ।


তাওয়াফে যিয়ারত

তাওয়াফে যিয়ারত হজ্জের তৃতীয় ফরজ। এটি ১০ই জিলহজ্জ থেকে ১২ই জিলহজ্জের মধ্যে কা‘বা শরীফের চারপাশে সাতবার প্রদক্ষিণ করা। এই তাওয়াফ হজ্জের মূল অংশ এবং এটি অবশ্যই পবিত্র অবস্থায় (ওযু বা গোসলের মাধ্যমে) সম্পন্ন করতে হয়। তাওয়াফের সময় হাজীগণ হাজরে আসওয়াদ (কালো পাথর) চুম্বন করেন বা দূর থেকে ইশারা করেন এবং নির্দিষ্ট দো‘আ পড়েন।


তাওয়াফের প্রতিটি চক্রে হাজীগণ কা‘বার চারপাশে ঘড়ির কাঁটার বিপরীতে হাঁটেন। প্রতিটি চক্র শুরু হয় হাজরে আসওয়াদ থেকে এবং সেখানেই শেষ হয়। প্রথম তিন চক্রে পুরুষদের জন্য রমল করা (কাঁধ খোলা রেখে দ্রুত হাঁটা) সুন্নত। তাওয়াফ শেষে মাকামে ইবরাহীমের কাছে দুই রাক‘আত নামায পড়া ওয়াজিব। তাওয়াফে যিয়ারত হজ্জের একটি অপরিহার্য অংশ এবং এটি আল্লাহর প্রতি ভক্তি ও নৈকট্য প্রকাশ করে।


হজ্জের ওয়াজিব

ওয়াজিব হলো হজ্জের সেই কাজগুলো, যা অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ এবং পালন করা আবশ্যক। তবে, এগুলো ফরজের তুলনায় কিছুটা কম গুরুত্বপূর্ণ। কোনো ওয়াজিব বাদ পড়লে হজ্জ বাতিল হয় না, তবে এর জন্য দম (কোরবানি) দিতে হয়। হজ্জের প্রধান ওয়াজিবগুলো নিম্নরূপ:


সাঈ

সাঈ হলো সাফা ও মারওয়া পাহাড়ের মধ্যে সাতবার হাঁটা। এটি তাওয়াফের পর সম্পন্ন করা হয়। সাঈয়ের সময় হাজীগণ হযরত হাজেরার স্মৃতির প্রতি শ্রদ্ধা জানান, যিনি তাঁর পুত্র হযরত ইসমাঈলের জন্য পানি খুঁজতে এই পাহাড়ের মধ্যে দৌড়েছিলেন।


সাঈ শুরু হয় সাফা পাহাড় থেকে এবং মারওয়ায় শেষ হয়। প্রতিটি চক্রে হাজীগণ নির্দিষ্ট দো‘আ পড়েন এবং আল্লাহর কাছে ক্ষমা প্রার্থনা করেন। সাঈয়ের সময় পুরুষদের জন্য দুটি সবুজ চিহ্নের মধ্যে দ্রুত হাঁটা (হারওয়ালা) সুন্নত। সাঈ না করলে হজ্জ অপূর্ণ থাকে এবং এর জন্য দম দিতে হয়।


মুযদালিফায় রাত্রিযাপন

৯ই জিলহজ্জ রাতে মুযদালিফায় খোলা আকাশের নিচে রাত্রিযাপন করা ওয়াজিব। আরাফাত থেকে সূর্যাস্তের পর হাজীগণ মুযদালিফায় পৌঁছান এবং মাগরিব ও ইশার নামায একসাথে আদায় করেন। এখানে তারা ফজরের নামায পড়েন এবং মিনায় যাওয়ার জন্য ৪৯টি পাথর সংগ্রহ করেন। মুযদালিফায় রাত্রিযাপন হাজীদের ধৈর্য ও ত্যাগের প্রতীক। এই সময় তারা আল্লাহর জিকির ও দো‘আয় মগ্ন থাকেন।


রমি জামারাত

রমি জামারাত হলো মিনায় তিনটি স্তম্ভে (জামারাত) পাথর নিক্ষেপ করা। এটি ১০ই, ১১ই এবং ১২ই জিলহজ্জ করা হয়। প্রতিটি স্তম্ভে সাতটি করে পাথর নিক্ষেপ করতে হয়। ১০ই জিলহজ্জ শুধুমাত্র বড় জামারায় (জামারাতুল আকাবা) পাথর নিক্ষেপ করা হয়, আর ১১ই ও ১২ই জিলহজ্জ তিনটি জামারায় (ছোট, মাঝারি, বড়) পাথর নিক্ষেপ করা হয়।


এই কাজটি হযরত ইবরাহীম আলাইহিস সালামের শয়তানকে প্রতিহত করার স্মরণে করা হয়। রমি জামারাতের সময় হাজীগণ দো‘আ পড়েন এবং আল্লাহর প্রতি তাদের আনুগত্য প্রকাশ করেন।


কোরবানি

হজ্জে কিরাম এবং হজ্জে তামাত্তু পালনকারীদের জন্য কোরবানি করা ওয়াজিব। এটি ১০ই জিলহজ্জ মিনায় সম্পন্ন করা হয়। কোরবানির মাধ্যমে হাজীগণ হযরত ইবরাহীম ও ইসমাঈল আলাইহিমুস সালামের ত্যাগের স্মৃতি উদযাপন করেন। কোরবানির প্রাণী হতে পারে ছাগল, ভেড়া, গরু বা উট।


কোরবানির মাংস তিন ভাগে বিভক্ত করা হয়: এক ভাগ নিজের জন্য, এক ভাগ আত্মীয়-স্বজনের জন্য, এবং এক ভাগ গরিব-দুঃখীদের জন্য। এটি সমাজে সমতা ও ভ্রাতৃত্ববোধ প্রতিষ্ঠায় সহায়তা করে।


মাথা মুণ্ডন বা চুল ছাঁটাই

হজ্জের শেষে মাথা মুণ্ডন করা বা চুল ছাঁটাই করা ওয়াজিব। পুরুষদের জন্য পূর্ণ মাথা মুণ্ডন করা (হালক) উত্তম, তবে চুল ছাঁটাই (কাসর)ও গ্রহণযোগ্য। মহিলারা তাদের চুলের অগ্রভাগ থেকে এক ইঞ্চি পরিমাণ ছাঁটেন। এই কাজটি হজ্জের সমাপ্তি এবং পবিত্রতার প্রতীক।


মাথা মুণ্ডন বা চুল ছাঁটাইয়ের পর হাজী ইহরাম থেকে মুক্ত হন এবং সাধারণ পোশাক পরতে পারেন।


তাওয়াফে বিদা‘আ

তাওয়াফে বিদা‘আ হলো মক্কা ত্যাগের আগে কা‘বা শরীফের চারপাশে সাতবার প্রদক্ষিণ করা। এটি হজ্জের শেষ ওয়াজিব এবং এর মাধ্যমে হাজীগণ কা‘বার প্রতি তাদের শ্রদ্ধা ও বিদায় জানান। তাওয়াফে বিদা‘আ শুধুমাত্র হজ্জে কিরাম ও তামাত্তু পালনকারীদের জন্য প্রযোজ্য। এই তাওয়াফের পর হাজীগণ জমজমের পানি পান করেন এবং কা‘বার দিকে মুখ করে দো‘আ করেন।


হজ্জের সুন্নত

সুন্নত হলো হজ্জের সেই কাজগুলো, যা রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম নিজে করেছেন বা করতে বলেছেন। এগুলো পালন করলে অতিরিক্ত সওয়াব পাওয়া যায়, তবে না করলে কোনো শাস্তি হয় না। হজ্জের কিছু গুরুত্বপূর্ণ সুন্নত নিম্নরূপ:


তালবিয়া পাঠ

ইহরাম বাঁধার পর থেকে তালবিয়া পাঠ করা সুন্নত। তালবিয়া হলো:


লাব্বাইক আল্লাহুম্মা লাব্বাইক, লাব্বাইক লা শারীকা লাকা লাব্বাইক, ইন্নাল হামদা ওয়ান নি‘মাতা লাকা ওয়াল মুলক, লা শারীকা লাক।


এর অর্থ: হে আল্লাহ! আমি হাযির, তোমার কোনো শরীক নেই, আমি হাযির। সকল প্রশংসা, নিয়ামত এবং রাজত্ব তোমারই, তোমার কোনো শরীক নেই। পুরুষদের জন্য তালবিয়া উচ্চস্বরে পড়া সুন্নত, এবং মহিলারা নিম্নস্বরে পড়েন। তালবিয়া পাঠ হজ্জের প্রতিটি পর্যায়ে চলতে থাকে, যতক্ষণ না হাজী মিনায় পাথর নিক্ষেপ শুরু করেন।


ইহরামের আগে গোসল

ইহরাম বাঁধার আগে গোসল করা এবং পরিষ্কার পোশাক পরা সুন্নত। এটি হজ্জের পবিত্রতা ও প্রস্তুতির অংশ। গোসলের সময় হাজী নিজেকে শারীরিক ও মানসিকভাবে প্রস্তুত করেন এবং আল্লাহর কাছে ক্ষমা প্রার্থনা করেন। যদি গোসল সম্ভব না হয়, তাহলে ওযু করাও যথেষ্ট।


মিনায় অবস্থান

৮ই জিলহজ্জ মিনায় অবস্থান করা এবং সেখানে পাঁচ ওয়াক্ত নামায পড়া সুন্নত। এই দিনটি হজ্জের প্রস্তুতির জন্য গুরুত্বপূর্ণ। হাজীগণ মিনায় তাঁবুতে থাকেন এবং আল্লাহর জিকির, কুরআন তিলাওয়াত ও দো‘আয় মগ্ন থাকেন। এই সময় তারা হজ্জের জন্য মানসিকভাবে প্রস্তুত হন।


তাওয়াফে কুদূম

মক্কায় পৌঁছানোর পর তাওয়াফে কুদূম করা সুন্নত। এটি হজ্জে কিরাম পালনকারীদের জন্য প্রযোজ্য। তাওয়াফে কুদূম হলো কা‘বার প্রতি শ্রদ্ধা জানানোর একটি উপায়। এই তাওয়াফের সময় পুরুষদের জন্য রমল করা এবং সাঈ সম্পন্ন করা সুন্নত। তাওয়াফে কুদূম হজ্জের শুরুতে হাজীদের আধ্যাত্মিক সংযোগ স্থাপন করে।


দো‘আ ও যিকর

হজ্জের বিভিন্ন স্থানে, যেমন আরাফাত, মুযদালিফা, মিনা এবং তাওয়াফের সময় নির্দিষ্ট দো‘আ ও যিকর পড়া সুন্নত। উদাহরণস্বরূপ:

  • আরাফাতে: লা ইলাহা ইল্লাল্লাহু ওয়াহদাহু লা শারীকা লাহু।
  • তাওয়াফের সময়: রাব্বানা আতিনা ফিদ দুনিয়া হাসানাতাও ওয়া ফিল আখিরাতি হাসানাতাও ওয়াকিনা আযাবান্নার।

এই দো‘আ ও যিকর হজ্জের আধ্যাত্মিক মাত্রা বৃদ্ধি করে এবং হাজীদের আল্লাহর সাথে সংযোগ মজবুত করে।


জমজমের পানি পান

তাওয়াফের পর জমজমের পানি পান করা এবং এর উপর দো‘আ পড়া সুন্নত। জমজমের পানি হলো হযরত হাজেরার প্রচেষ্টার ফল, এবং এটি পান করা হাজীদের জন্য আধ্যাত্মিক শক্তি প্রদান করে। হাজীগণ জমজম পান করার সময় দো‘আ করেন এবং আল্লাহর কাছে শারীরিক ও আধ্যাত্মিক কল্যাণ কামনা করেন।


মুলতাযামে দো‘আ

কা‘বার দরজা ও হাজরে আসওয়াদের মাঝের স্থানে (মুলতাযাম) দাঁড়িয়ে দো‘আ করা সুন্নত। এই স্থানে দো‘আ কবুল হওয়ার সম্ভাবনা বেশি বলে বিশ্বাস করা হয়। হাজীগণ এখানে দাঁড়িয়ে নিজেদের, পরিবারের এবং মুসলিম উম্মাহর জন্য দো‘আ করেন।


হাজরে আসওয়াদের চুম্বন

তাওয়াফের সময় হাজরে আসওয়াদ চুম্বন করা বা এর দিকে ইশারা করা সুন্নত। যদি ভিড়ের কারণে চুম্বন সম্ভব না হয়, তাহলে দূর থেকে হাত দিয়ে ইশারা করে তাকবীর দিয়ে (আল্লাহু আকবর বলে) এটি সম্পন্ন করা হয়।


মাকামে ইবরাহীমে নামায

তাওয়াফের পর মাকামে ইবরাহীমের কাছে দুই রাক‘আত নামায পড়া সুন্নত। এই নামাযে সূরা কাফিরুন এবং সূরা ইখলাস পড়া উত্তম। এটি হযরত ইবরাহীম আলাইহিস সালামের স্মৃতির প্রতি শ্রদ্ধা জানানোর একটি উপায়।


আরাফাতে খুতবা শ্রবণ

৯ই জিলহজ্জ আরাফাতে খুতবা শ্রবণ করা সুন্নত। এই খুতবায় হজ্জের গুরুত্ব, নিয়মাবলী এবং আধ্যাত্মিক তাৎপর্য সম্পর্কে আলোচনা করা হয়। হাজীগণ এই খুতবা মনোযোগ দিয়ে শোনেন এবং এর শিক্ষা গ্রহণ করেন।


হজ্জের ফরজ, ওয়াজিব ও সুন্নতের মধ্যে পার্থক্য

হজ্জের ফরজ, ওয়াজিব এবং সুন্নতের মধ্যে মৌলিক পার্থক্য রয়েছে। ফরজ হলো হজ্জের মূল ভিত্তি, যা না করলে হজ্জ বাতিল হয়। ওয়াজিব হলো গুরুত্বপূর্ণ কাজ, যা বাদ দিলে হজ্জ অপূর্ণ থাকে এবং দম দিতে হয়। সুন্নত হলো ঐচ্ছিক কাজ, যা পালন করলে সওয়াব বৃদ্ধি পায়, তবে না করলে কোনো শাস্তি হয় না। উদাহরণস্বরূপ:

  • ফরজ: ইহরাম বাঁধা না করলে হজ্জ শুরুই হয় না।
  • ওয়াজিব: সাঈ বাদ দিলে দম দিতে হয়।
  • সুন্নত: তালবিয়া পাঠ না করলে সওয়াব কমে, তবে হজ্জের ক্ষতি হয় না।

এই তিনটি শ্রেণি একে অপরের পরিপূরক এবং হজ্জের পূর্ণতা নির্ভর করে এগুলোর সঠিক পালনের উপর।


হজ্জ পালনের ব্যবহারিক পরামর্শ

হজ্জ একটি শারীরিক ও আধ্যাত্মিকভাবে কঠিন ইবাদত। তাই এটি সঠিকভাবে পালনের জন্য কিছু ব্যবহারিক পরামর্শ নিম্নরূপ:

  • প্রস্তুতি: হজ্জের নিয়মাবলী ভালোভাবে শিখে নিন। একজন আলেম বা অভিজ্ঞ হাজীর সাথে পরামর্শ করুন। হজ্জের বই পড়ুন এবং প্রশিক্ষণ কর্মশালায় অংশ নিন।
  • ধৈর্য: হজ্জের সময় ভিড়, গরম আবহাওয়া এবং দীর্ঘ অপেক্ষার সম্মুখীন হতে হয়। ধৈর্য ধরুন এবং কোনো পরিস্থিতিতে রাগ বা বিরক্তি প্রকাশ করবেন না।
  • নিয়ত: হজ্জ শুধুমাত্র আল্লাহর সন্তুষ্টির জন্য পালন করুন। সামাজিক মর্যাদা বা প্রশংসার জন্য হজ্জ করা থেকে বিরত থাকুন।
  • স্বাস্থ্য: শারীরিকভাবে ফিট থাকুন। হাঁটার অভ্যাস করুন এবং প্রয়োজনীয় ঔষধ সাথে রাখুন। হজ্জের সময় পানিশূন্যতা এড়াতে পর্যাপ্ত পানি পান করুন।
  • সঙ্গী নির্বাচন: ভালো সঙ্গী নির্বাচন করুন, যারা আপনাকে ধৈর্য ধরতে এবং সঠিকভাবে ইবাদত করতে সহায়তা করবে।
  • দো‘আর তালিকা: হজ্জের সময় দো‘আর একটি তালিকা তৈরি করুন। এতে নিজের, পরিবারের এবং মুসলিম উম্মাহর জন্য দো‘আ অন্তর্ভুক্ত করুন।
  • সময় ব্যবস্থাপনা: হজ্জের সময়সূচি সম্পর্কে সচেতন থাকুন এবং প্রতিটি কাজ নির্দিষ্ট সময়ে সম্পন্ন করুন।
  • পবিত্রতা: সবসময় ওযু বা গোসলের মাধ্যমে পবিত্র থাকুন। এটি হজ্জের ইবাদতকে আরও ফলপ্রসূ করে।
  • সাংগঠনিক প্রস্তুতি: প্রয়োজনীয় জিনিসপত্র, যেমন আরামদায়ক জুতা, ছাতা, এবং হালকা ব্যাগ সাথে রাখুন।
  • আর্থিক পরিকল্পনা: হজ্জের খরচের জন্য আগে থেকে পরিকল্পনা করুন এবং অতিরিক্ত অর্থ সাথে রাখুন জরুরি প্রয়োজনের জন্য।

হজ্জের আধ্যাত্মিক গুরুত্ব

হজ্জ শুধুমাত্র একটি শারীরিক ইবাদত নয়, বরং এটি আধ্যাত্মিক পুনর্জন্মের একটি সুযোগ। হজ্জের মাধ্যমে মুসলিমরা তাদের গুনাহ থেকে মুক্তি পান এবং আল্লাহর নৈকট্য লাভ করেন। রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম বলেছেন:


যে ব্যক্তি হজ্জ করে এবং কোনো অশ্লীল কাজ বা গুনাহে লিপ্ত না হয়, সে এমনভাবে ফিরে আসে যেন সে তার মায়ের গর্ভ থেকে নতুন জন্ম নিয়েছে।


হজ্জের প্রতিটি কাজ, যেমন তাওয়াফ, সাঈ, আরাফাতে অবস্থান, রমি জামারাত ইত্যাদি, হাজীদের ত্যাগ, ধৈর্য এবং আল্লাহর প্রতি আনুগত্য শেখায়। এটি মুসলিমদের মধ্যে ঐক্য ও সমতার বার্তা প্রচার করে, কারণ হজ্জে সবাই একই পোশাক পরে এবং একই উদ্দেশ্যে একত্রিত হয়। হজ্জ হলো একটি সার্বজনীন ইবাদত, যা বিশ্বের বিভিন্ন প্রান্ত থেকে মুসলিমদের একত্রিত করে এবং তাদের মধ্যে ভ্রাতৃত্ববোধ জাগ্রত করে।


হজের ফরজ, ওয়াজিব ও সুন্নত সম্পর্কে কিছু সাধারন জিজ্ঞাসিত প্রশ্ন (FAQ)

হজ্জ পালনের সময় হাজীদের মনে বিভিন্ন প্রশ্ন জাগে। নিম্নে হজ্জ সম্পর্কিত ১০টি প্রায়শই জিজ্ঞাসিত প্রশ্ন ও তার উত্তর দেওয়া হলো:

হজ্জ কি এবং কেন এটি ফরজ?

হজ্জ ইসলামের পঞ্চম স্তম্ভ এবং এটি আল্লাহ তা‘আলার নির্দেশে প্রতিটি সামর্থ্যবান মুসলিমের জন্য জীবনে একবার ফরজ। কুরআনে সূরা আল-ইমরান (৩:৯৭) এ বলা হয়েছে, “মানুষের উপর আল্লাহর জন্য বাইতুল্লাহর হজ্জ করা ফরজ, যারা এর পথে সামর্থ্য রাখে।” হজ্জ আল্লাহর প্রতি ভক্তি ও আনুগত্য প্রকাশ করে।


ইহরাম কীভাবে বাঁধতে হয়?

ইহরাম বাঁধতে হলে প্রথমে গোসল বা ওযু করতে হয়, তারপর ইহরামের পোশাক পরতে হয়। এরপর দুই রাক‘আত নফল নামায পড়ে হজ্জের নিয়ত করতে হয় এবং তালবিয়া পাঠ করতে হয়। মীকাতে পৌঁছে এটি সম্পন্ন করা বাধ্যতামূলক।


আরাফাতে অবস্থানের গুরুত্ব কী?

আরাফাতে অবস্থান হজ্জের মূল ফরজ এবং এটি ছাড়া হজ্জ পূর্ণ হয় না। এটি হজ্জের সবচেয়ে আধ্যাত্মিক মুহূর্ত, যখন হাজীগণ আল্লাহর কাছে ক্ষমা প্রার্থনা করেন এবং তওবা করেন। রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম বলেছেন, “হজ্জ হলো আরাফাত।”


তাওয়াফে যিয়ারত ও তাওয়াফে বিদা‘আর মধ্যে পার্থক্য কী?

তাওয়াফে যিয়ারত হলো হজ্জের ফরজ, যা ১০ই থেকে ১২ই জিলহজ্জের মধ্যে করতে হয়। এটি হজ্জের মূল অংশ। তাওয়াফে বিদা‘আ হলো ওয়াজিব, যা মক্কা ত্যাগের আগে করা হয় এবং এটি কা‘বার প্রতি বিদায় জানানোর উপায়।


কোন কাজগুলো ইহরামের সময় নিষিদ্ধ?

ইহরামের সময় নিষিদ্ধ কাজগুলো হলো: চুল-নখ কাটা, সুগন্ধি ব্যবহার, শিকার করা, স্বামী-স্ত্রীর শারীরিক সম্পর্ক, ঝগড়া বা অশ্লীল কথাবার্তা। এগুলো করলে দম বা ফিদিয়া দিতে হয়।


সাঈ কী এবং এটি কেন গুরুত্বপূর্ণ?

সাঈ হলো সাফা ও মারওয়া পাহাড়ের মধ্যে সাতবার হাঁটা। এটি হযরত হাজেরার পানি খোঁজার প্রচেষ্টার স্মরণে করা হয়। সাঈ হজ্জের ওয়াজিব এবং এটি না করলে দম দিতে হয়।


রমি জামারাত কীভাবে করতে হয়?

রমি জামারাত হলো মিনায় তিনটি স্তম্ভে সাতটি করে পাথর নিক্ষেপ করা। ১০ই জিলহজ্জ শুধুমাত্র বড় জামারায়, আর ১১ই ও ১২ই জিলহজ্জ তিনটি জামারায় পাথর নিক্ষেপ করা হয়। পাথর নিক্ষেপের সময় তাকবীর দিতে হয়।


কোরবানি কাদের জন্য ওয়াজিব?

কোরবানি হজ্জে কিরাম এবং হজ্জে তামাত্তু পালনকারীদের জন্য ওয়াজিব। এটি ১০ই জিলহজ্জ মিনায় সম্পন্ন করা হয় এবং এর মাধ্যমে হযরত ইবরাহীমের ত্যাগের স্মৃতি পালন করা হয়।


তালবিয়া কখন বন্ধ করতে হয়?

তালবিয়া পাঠ হজ্জের শুরু থেকে চলতে থাকে এবং ১০ই জিলহজ্জ মিনায় বড় জামারায় পাথর নিক্ষেপ শুরু করার সময় বন্ধ করতে হয়।


হজ্জের সময় কীভাবে ধৈর্য ধরবেন?

হজ্জের সময় ভিড়, গরম এবং ক্লান্তির সম্মুখীন হতে হয়। ধৈর্য ধরতে আল্লাহর জিকির করুন, দো‘আ পড়ুন, এবং হজ্জের আধ্যাত্মিক উদ্দেশ্যের উপর মনোযোগ দিন। ভালো সঙ্গী নির্বাচন করুন এবং সব পরিস্থিতিতে শান্ত থাকুন।

 

হজ্জ ইসলামের একটি মহান ইবাদত, যা মুসলিমদের আল্লাহর নৈকট্য লাভের সুযোগ দেয়। ফরজ, ওয়াজিব এবং সুন্নতের সঠিক পালন হজ্জকে পরিপূর্ণ করে। ফরজ হলো হজ্জের ভিত্তি, ওয়াজিব হলো এর গুরুত্বপূর্ণ অংশ, এবং সুন্নত হলো এর সৌন্দর্য। এই প্রবন্ধে আমরা হজ্জের প্রতিটি নিয়মের বিস্তারিত ব্যাখ্যা এবং প্রায়শই জিজ্ঞাসিত প্রশ্নের উত্তর প্রদান করেছি, যাতে হাজীগণ তাদের হজ্জ সঠিকভাবে সম্পন্ন করতে পারেন। হজ্জ পালনকারীদের উচিত এই নিয়মাবলী মনোযোগ দিয়ে শিখে নেওয়া এবং আন্তরিকতার সাথে পালন করা। আল্লাহ তা‘আলা সকল মুসলিমকে হজ্জে মকবুল করার তৌফিক দান করুন। আমীন।

 


Share
Comments
কমেন্ট করতে লগইন করুন। লগইন | রেজিস্ট্রেশন

No Data Found