হজ্জ ইসলামের পাঁচটি স্তম্ভ এর মধ্যে একটি এবং ধনি মুসলিমদের জন্য একটি অত্যন্ত পবিত্র ইবাদত। এটি আল্লাহর নৈকট্য লাভের জন্য শারীরিক, আর্থিক ও আধ্যাত্মিক ত্যাগের একটি অনন্য সুযোগ।
হজ্জের মূল কার্যক্রম পাঁচ দিনে সম্পন্ন হয়, যা ৮ থেকে ১২ বা ১৩ যিলহজ্জ পর্যন্ত বিস্তৃত। এই সময়ে হাজিরা মক্কা, মিনা, আরাফাত, মুজদালিফা ও জামারাতে নির্দিষ্ট আচার পালন করেন, যেমন ইহরাম বাঁধা, তাওয়াফ, সাঈ, আরাফাতে অবস্থান, পাথর নিক্ষেপ ও কুরবানি।
এই নিয়মগুলো হজ্জের পূর্ণতা ও আল্লাহর কাছে গ্রহণযোগ্যতার জন্য অপরিহার্য। এই নিবন্ধে হজ্জের পাঁচ দিনের বিস্তারিত গাইড, প্রতিটি দিনের নিয়ম, এর আধ্যাত্মিক তাৎপর্য এবং ব্যবহারিক পরামর্শ সাধারণ ভাষায় তুলে ধরা হবে।
হজ্জের পাঁচ দিন: একটি সংক্ষিপ্ত পরিচিতি
হজ্জের মূল আচারগুলো ৮ যিলহজ্জ থেকে শুরু হয় এবং সাধারণত ১২ বা ১৩ যিলহজ্জ পর্যন্ত চলে। এই পাঁচ দিনে হাজিরা বিভিন্ন স্থানে যান এবং নির্দিষ্ট আচার পালন করেন। প্রতিটি দিনের নিয়ম হজ্জের ধরন (তামাত্তু, কিরান বা ইফরাদ) এবং স্থানীয় ব্যবস্থাপনার উপর কিছুটা ভিন্ন হতে পারে, তবে মূল কাঠামো একই থাকে। এই দিনগুলোতে হাজিরা আল্লাহর ইবাদত, দোয়া, তওবা ও যিকিরে নিজেদের নিয়োজিত রাখেন। নিম্নে প্রতিটি দিনের বিস্তারিত আলোচনা করা হলো।
প্রথম দিন: ৮ যিলহজ্জ (ইয়াওমুত তারওয়িয়া)
৮ যিলহজ্জকে ইয়াওমুত তারওয়িয়া বলা হয়, যার অর্থ "পানি সংগ্রহের দিন"। এই নামটি এসেছে অতীতে হাজিদের এই দিনে পরবর্তী দিনগুলোর জন্য পানি সংগ্রহের প্রথা থেকে। এই দিনটি হজ্জের আনুষ্ঠানিক শুরু এবং হাজিদের জন্য প্রস্তুতির সময়। নিয়মগুলো হলো:
- ইহরাম বাঁধা: হজ্জ শুরুর জন্য হাজিরা মক্কায় বা মীকাত সীমানায় (যেমন যুল হুলাইফা, জুহফা) ইহরাম বাঁধেন। ইহরাম হলো হজ্জের পবিত্র অবস্থা, যেখানে হাজি হজ্জের উদ্দেশ্যে নিয়ত করেন এবং নির্দিষ্ট পোশাক পরেন। পুরুষরা দুই টুকরো অসেলাই করা সাদা কাপড় (ইজার ও রিদা) পরেন, যা কোমর ও কাঁধ ঢাকে। মহিলারা তাদের সাধারণ পর্দানশীল পোশাক, যেমন হিজাব বা বোরকা, পরেন। ইহরামের সময় হাজি তালবিয়া পড়েন: "লাব্বাইক আল্লাহুম্মা লাব্বাইক, লাব্বাইকা লা শারিকা লাকা লাব্বাইক, ইন্নাল হামদা ওয়ান নি’মাতা লাকা ওয়াল মুলক, লা শারিকা লাক।" এই তালবিয়া আল্লাহর ডাকে সাড়া দেওয়ার প্রতীক।
- মক্কা থেকে মিনায় যাওয়া: ইহরাম বাঁধার পর হাজিরা মক্কা থেকে মিনার উদ্দেশ্যে রওনা হন। মিনা মক্কার কাছে একটি উপত্যকা, যেখানে হাজিরা তাঁবুতে থাকেন। এই দিনে হাজিরা মিনায় দিনের বাকি সময় ও রাত কাটান। মিনার তাঁবুগুলো হাজিদের জন্য অস্থায়ী আবাসস্থল, যেখানে তারা ইবাদত ও বিশ্রামে সময় কাটান।
- নামাজ আদায়: মিনায় পাঁচ ওয়াক্ত নামাজ আদায় করা হয়। জোহর, আসর, মাগরিব ও ইশার নামাজ সংক্ষিপ্ত (কসর) করে পড়া হয়, অর্থাৎ চার রাকাতের নামাজ দুই রাকাতে পড়া হয়। তবে, নামাজগুলো জামাতের সাথে সময়মতো আদায় করা হয়। পরের দিন ফজরের নামাজও মিনায় পড়া হয়।
- দোয়া ও যিকির: এই দিনে হাজিরা তালবিয়া পড়া চালিয়ে যান, যা হজ্জের সময় বারবার পড়া হয়। এছাড়া, কুরআন তিলাওয়াত, আল্লাহর যিকির (যেমন সুবহানাল্লাহ, আলহামদুলিল্লাহ), দোয়া ও তওবায় সময় কাটানো উত্তম। এটি হজ্জের জন্য মানসিক প্রস্তুতির সময়।
- নিষিদ্ধ কাজ এড়ানো: ইহরামের অবস্থায় হাজিদের কিছু কাজ থেকে বিরত থাকতে হয়, যেমন সুগন্ধি ব্যবহার, চুল বা নখ কাটা, সেলাই করা পোশাক পরা (পুরুষদের জন্য), মাথা ঢাকা (পুরুষদের জন্য), যৌন সম্পর্ক, শিকার করা, ঝগড়া বা অশ্লীল কথাবার্তা। এই নিষেধাজ্ঞাগুলো হজ্জের পবিত্রতা বজায় রাখে।
আধ্যাত্মিক তাৎপর্য:
ইয়াওমুত তারওয়িয়া হজ্জের আধ্যাত্মিক যাত্রার সূচনা। ইহরামের মাধ্যমে হাজিরা দুনিয়াবি সব কিছু থেকে নিজেদের বিচ্ছিন্ন করে শুধু আল্লাহর ইবাদতের জন্য নিজেদের উৎসর্গ করেন। তালবিয়া পাঠ আল্লাহর ডাকে সাড়া দেওয়ার প্রতিশ্রুতি। মিনায় অবস্থান হাজিদের মধ্যে ঐক্য ও ভ্রাতৃত্বের বন্ধন সৃষ্টি করে, কারণ সবাই একই ধরনের পোশাক পরে এবং একই তাঁবুতে থাকে। এই দিনটি হাজিদের মনে ধৈর্য, নম্রতা ও আল্লাহর প্রতি নির্ভরতার মনোভাব জাগায়।
ব্যবহারিক পরামর্শ:
- ইহরাম বাঁধার আগে গোসল করে নিন, নখ-চুল পরিপাটি করুন এবং পরিষ্কার পোশাক পরুন। এটি ইহরামের পবিত্রতার জন্য গুরুত্বপূর্ণ।
- সুগন্ধিমুক্ত সাবান, টুথপেস্ট ও ক্রিম ব্যবহার করুন, কারণ ইহরামে সুগন্ধি নিষিদ্ধ।
- মিনায় ভিড় ও গরমের জন্য প্রস্তুত থাকুন। পর্যাপ্ত পানি, হালকা খাবার ও ছায়ার জন্য ছাতা সঙ্গে রাখুন।
- তালবিয়া, দোয়া ও যিকিরের জন্য একটি ছোট দোয়ার বই বা মোবাইল অ্যাপ ব্যবহার করুন।
- মিনায় তাঁবুর স্থান সীমিত হতে পারে, তাই ধৈর্য ধরুন এবং সহযাত্রীদের সাথে সহযোগিতা করুন।
দ্বিতীয় দিন: ৯ যিলহজ্জ (ইয়াওমুল আরাফা)
৯ যিলহজ্জকে ইয়াওমুল আরাফা বলা হয়, যা হজ্জের সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ দিন। এই দিনে আরাফাতে অবস্থান করা হজ্জের মূল আচার এবং এটি হজ্জের প্রাণ হিসেবে বিবেচিত হয়। নিয়মগুলো হলো:
- মিনা থেকে আরাফাতে যাওয়া: ফজরের নামাজের পর হাজিরা মিনা থেকে আরাফাতের উদ্দেশ্যে রওনা হন। আরাফাত মক্কার কাছে একটি বিস্তৃত ময়দান, যেখানে হাজিরা তাঁবুতে অবস্থান করেন। এই যাত্রা সাধারণত সকালে শুরু হয়, এবং হাজিরা দুপুরের আগে আরাফাতে পৌঁছে যান।
- ওকুফে আরাফা: দুপুর থেকে সূর্যাস্ত পর্যন্ত আরাফাতের ময়দানে অবস্থান করা হজ্জের সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ আচার। এটিকে "ওকুফে আরাফা" বলা হয়। হাজিরা এই সময়ে দাঁড়িয়ে বা বসে আল্লাহর কাছে দোয়া করেন, তওবা করেন, তালবিয়া পড়েন এবং যিকিরে মগ্ন থাকেন। রাসূলুল্লাহ (সা.) বলেছেন, “হজ্জ হলো আরাফা” এবং “আরাফার দিনের দোয়া সর্বোত্তম দোয়া।” এই সময়ে হাজিরা নিজেদের পাপের জন্য ক্ষমা প্রার্থনা করেন এবং আল্লাহর রহমত কামনা করেন।
- খুতবা শ্রবণ: আরাফাতের নামিরা মসজিদে জোহরের আগে একটি খুতবা দেওয়া হয়, যা হজ্জের তাৎপর্য, ইসলামের শিক্ষা ও আল্লাহর প্রতি আনুগত্যের কথা ব্যাখ্যা করে। এই খুতবা শ্রবণ করা উত্তম, তবে সবাই মসজিদে উপস্থিত থাকতে পারেন না বলে তাঁবু থেকেও এটি শোনা যায়।
- জোহর ও আসর নামাজ: আরাফাতে জোহর ও আসর নামাজ একসাথে জোহরের সময় পড়া হয়। এই নামাজগুলো সংক্ষিপ্ত (দুই রাকাত) করা হয় এবং এক আযান ও দুই ইকামতের মাধ্যমে আদায় করা হয়। এটি হাজিদের দোয়া ও যিকিরের জন্য সময় বাঁচায়।
- মুজদালিফায় রাত্রিযাপন: সূর্যাস্তের পর হাজিরা আরাফাত থেকে মুজদালিফার উদ্দেশ্যে রওনা হন। মুজদালিফা একটি খোলা ময়দান, যেখানে হাজিরা খোলা আকাশের নিচে রাত কাটান। এখানে মাগরিব ও ইশার নামাজ একসাথে ইশার সময় পড়া হয়। হাজিরা মুজদালিফায় পরবর্তী দিনের জামারাতে পাথর নিক্ষেপের জন্য ৭০টি কংকর সংগ্রহ করেন।
- দোয়া ও যিকির: আরাফাতে ও মুজদালিফায় হাজিরা অধিকাংশ সময় দোয়া, তালবিয়া, তাসবিহ ও কুরআন তিলাওয়াতে কাটান। এই সময়টি আল্লাহর সাথে সরাসরি সংযোগ স্থাপনের সুযোগ।
আধ্যাত্মিক তাৎপর্য:
ইয়াওমুল আরাফা হজ্জের সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ দিন, কারণ এটি আল্লাহর কাছে ক্ষমা প্রার্থনা ও রহমত লাভের দিন। আরাফাতে অবস্থান হাজিদের আধ্যাত্মিক পুনর্জনমের প্রতীক, যেখানে তারা নিজেদের পাপ থেকে মুক্তি কামনা করেন। এই দিনে আল্লাহ বান্দাদের প্রতি বিশেষ রহমত নাযিল করেন।
মুজদালিফায় রাত্রিযাপন ধৈর্য, সরলতা ও আল্লাহর প্রতি নির্ভরতার শিক্ষা দেয়। খোলা আকাশের নিচে থাকা হাজিদের নিজেদের নগণ্যতা ও আল্লাহর মহত্ত্ব অনুভব করায়। এই দিনটি হাজিদের মনে আল্লাহর প্রতি ভালোবাসা ও ভয়ের সমন্বয় সৃষ্টি করে।
ব্যবহারিক পরামর্শ:
- আরাফাতে দীর্ঘ সময় দাঁড়িয়ে থাকতে হতে পারে, তাই আরামদায়ক জুতা ও হালকা পোশাক পরুন।
- সূর্যের তাপ থেকে বাঁচতে ছাতা বা টুপি (মহিলাদের জন্য) ব্যবহার করুন।
- দোয়ার জন্য একটি তালিকা তৈরি করুন, যাতে নিজের, পরিবারের ও অন্যদের জন্য দোয়া করতে ভুল না হয়।
- মুজদালিফায় রাত্রিযাপনের জন্য একটি হালকা কম্বল বা চাদর সঙ্গে রাখুন, কারণ রাতে ঠান্ডা হতে পারে।
- কংকর সংগ্রহের সময় ছোট কংকর বাছুন এবং এগুলো একটি ছোট ব্যাগে রাখুন।
তৃতীয় দিন: ১০ যিলহজ্জ (ইয়াওমুন নাহর)
১০ যিলহজ্জকে ইয়াওমুন নাহর বলা হয়, যার অর্থ "কুরবানির দিন"। এই দিনটি ঈদুল আযহার দিন এবং হজ্জের গুরুত্বপূর্ণ আচারগুলো এই দিনে সম্পন্ন হয়। নিয়মগুলো হলো:
- মুজদালিফা থেকে মিনায় ফিরে যাওয়া: ফজরের নামাজের পর হাজিরা মুজদালিফা থেকে মিনায় ফিরে যান। মুজদালিফায় থাকাকালীন হাজিরা জামারাতে পাথর নিক্ষেপের জন্য ৭০টি কংকর সংগ্রহ করে রাখেন।
- জামারাতে পাথর নিক্ষেপ: মিনায় পৌঁছে হাজিরা জামরাতুল আকাবা (বড় জামরা) এ ৭টি কংকর নিক্ষেপ করেন। প্রতিটি কংকর নিক্ষেপের সময় "আল্লাহু আকবার" বলা হয়। এই পাথর নিক্ষেপ সূর্যোদয়ের পর থেকে দুপুরের আগে করা উত্তম। এটি হযরত ইব্রাহিম (আ.)-এর শয়তানের প্রলোভন প্রত্যাখ্যানের স্মরণ করায়।
- কুরবানি: হজ্জে তামাত্তু বা কিরান পালনকারীদের জন্য কুরবানি করা প্রয়োজন। এটি সাধারণত একটি ছাগল, ভেড়া বা গরুর এক-সপ্তমাংশ। কুরবানির মাংস গরিবদের মধ্যে বিতরণ করা হয়। আধুনিক সময়ে কুরবানির ব্যবস্থা সৌদি কর্তৃপক্ষের মাধ্যমে সংগঠিত হয়, এবং হাজিরা কুরবানির ভাউচার কিনে এই দায়িত্ব পালন করেন।
- চুল কাটা বা মুণ্ডন (হালক বা তাকসীর): কুরবানির পর হাজিরা ইহরামের পোশাক খুলে চুল কাটেন বা মুণ্ডন করেন। পুরুষদের জন্য পুরো মাথা মুণ্ডন (হালক) উত্তম, তবে চুল ছোট করাও (তাকসীর) জায়েজ। মহিলারা তাদের চুলের অগ্রভাগ থেকে এক আঙুল পরিমাণ ছোট করেন। এটি ইহরামের আংশিক সমাপ্তির প্রতীক।
- তাওয়াফে যিয়ারাত: মিনা থেকে মক্কায় ফিরে হাজিরা কাবা শরিফের চারপাশে তাওয়াফে যিয়ারাত করেন, যা হজ্জের একটি প্রধান আচার। এটি সাত চক্করে সম্পন্ন হয়, এবং প্রতি চক্করে কাবার হাজরে আসওয়াদ (কালো পাথর) চুম্বন বা ইশারা করা হয়। তাওয়াফের পর দুই রাকাত নামাজ পড়া হয় মাকামে ইব্রাহিমের কাছে।
- সাঈ: তাওয়াফে যিয়ারাতের পর হাজিরা সাফা ও মারওয়া পাহাড়ের মধ্যে সাতবার হেঁটে সাঈ করেন। এটি হযরত হাজেরা (আ.)-এর পানির সন্ধানে দৌড়ানোর স্মরণ করায়। সাঈ-এর সময় দোয়া ও যিকির করা হয়।
- মিনায় ফিরে যাওয়া: তাওয়াফ ও সাঈ-এর পর হাজিরা মিনায় ফিরে রাত্রিযাপন করেন। মিনায় পাঁচ ওয়াক্ত নামাজ আদায় করা হয়।
আধ্যাত্মিক তাৎপর্য:
ইয়াওমুন নাহর হজ্জের ব্যস্ততম দিন, যেখানে একাধিক আচার পালন করা হয়। জামরাতে পাথর নিক্ষেপ শয়তানের প্রলোভন প্রত্যাখ্যান ও আল্লাহর প্রতি আনুগত্যের প্রতীক। কুরবানি হযরত ইব্রাহিম (আ.) ও ইসমাঈল (আ.)-এর ত্যাগের স্মরণ করায় এবং আল্লাহর জন্য প্রিয় জিনিস উৎসর্গ করার শিক্ষা দেয়।
তাওয়াফে যিয়ারাত কাবার প্রতি ভালোবাসা ও আল্লাহর ঘরের চারপাশে ঘুরে ঐক্যের বন্ধন সৃষ্টি করে। সাঈ হযরত হাজেরা (আ.)-এর ধৈর্য ও আল্লাহর উপর ভরসার প্রতীক। এই দিনটি হাজিদের ত্যাগ, আনুগত্য ও ভালোবাসার সমন্বয় ঘটায়।
ব্যবহারিক পরামর্শ:
- জামরাতে পাথর নিক্ষেপের সময় ভিড় এড়াতে সকালের প্রথম ভাগে যান এবং নির্দেশনা মেনে চলুন।
- কুরবানির ভাউচার আগেই কিনে রাখুন এবং নিশ্চিত করুন যে এটি সময়মতো সম্পন্ন হয়েছে।
- চুল কাটার জন্য মিনা বা মক্কায় নির্ধারিত নাপিতের দোকান ব্যবহার করুন।
- তাওয়াফ ও সাঈ-এর জন্য পানি ও আরামদায়ক জুতা সঙ্গে রাখুন। ভিড়ের কারণে ধৈর্য ধরুন।
- তাওয়াফের সময় কাবার কাছে যাওয়ার চেষ্টা না করে নিরাপদ দূরত্বে থাকুন।
চতুর্থ দিন: ১১ যিলহজ্জ (ইয়াওমুত তাশরীক)
১১ যিলহজ্জ তাশরীকের প্রথম দিন। তাশরীকের দিনগুলো (১১, ১২ ও ১৩ যিলহজ্জ) হজ্জের শেষ পর্যায় এবং আল্লাহর যিকির ও শুকরিয়ার সময়। নিয়মগুলো হলো:
- জামারাতে পাথর নিক্ষেপ: মিনায় হাজিরা তিনটি জামরায় (ছোট, মাঝারি ও বড়) ৭টি করে মোট ২১টি কংকর নিক্ষেপ করেন। এটি জোহরের পর থেকে সূর্যাস্তের মধ্যে করা হয়। প্রতিটি কংকর নিক্ষেপের সময় "আল্লাহু আকবার" বলা হয়। ছোট ও মাঝারি জামরায় নিক্ষেপের পর দোয়া করা হয়, তবে বড় জামরায় দোয়া করা হয় না।
- তাকবিরে তাশরীক: তাশরীকের দিনগুলোতে প্রতি ফরজ নামাজের পর তাকবিরে তাশরীক পড়া হয়: "আল্লাহু আকবার, আল্লাহু আকবার, লা ইলাহা ইল্লাল্লাহু, ওয়াল্লাহু আকবার, আল্লাহু আকবার, ওয়া লিল্লাহিল হামদ।" এটি আল্লাহর প্রশংসা ও শুকরিয়ার প্রকাশ।
- মিনায় রাত্রিযাপন: হাজিরা মিনায় তাঁবুতে রাত কাটান এবং পাঁচ ওয়াক্ত নামাজ আদায় করেন। মিনায় থাকার সময় হাজিরা দোয়া, যিকির ও কুরআন তিলাওয়াতে সময় কাটান।
- দোয়া ও যিকির: পাথর নিক্ষেপের পর এবং মিনায় অবস্থানের সময় হাজিরা আল্লাহর কাছে দোয়া করেন, তালবিয়া পড়েন এবং যিকিরে মগ্ন থাকেন। এই সময়টি হজ্জের অভিজ্ঞতা প্রতিফলিত করার জন্য উপযুক্ত।
আধ্যাত্মিক তাৎপর্য:
তাশরীকের দিনগুলো আল্লাহর শুকরিয়া ও যিকিরের সময়। জামরাতে পাথর নিক্ষেপ শয়তানের বিরুদ্ধে প্রতিরোধ ও আল্লাহর প্রতি অবিচল থাকার প্রতীক। তাকবিরে তাশরীক আল্লাহর মহত্ত্ব ও প্রশংসা প্রকাশ করে। মিনায় অবস্থান হাজিদের ধৈর্য ও শৃঙ্খলা বৃদ্ধি করে এবং তাদের মধ্যে ঐক্যের বন্ধনকে আরও শক্তিশালী করে। এই দিনটি হাজিদের হজ্জের ত্যাগ ও ইবাদতের প্রতি কৃতজ্ঞতা জাগায়।
ব্যবহারিক পরামর্শ:
- পাথর নিক্ষেপের সময় সঠিক ক্রম (ছোট, মাঝারি, বড়) মেনে চলুন এবং নির্দেশিত পথ ব্যবহার করুন।
- তাকবিরে তাশরীক জোরে পড়ুন, যাতে অন্যরাও শুনতে পায়।
- মিনায় তাঁবুতে জায়গা সীমিত হতে পারে, তাই সহযাত্রীদের সাথে সহযোগিতা করুন।
- পর্যাপ্ত বিশ্রাম নিন, কারণ পাথর নিক্ষেপ ও হাঁটাচলায় শরীর ক্লান্ত হতে পারে।
- দোয়া ও যিকিরের জন্য সময় বের করুন এবং হজ্জের অভিজ্ঞতা নিয়ে চিন্তা করুন।
পঞ্চম দিন: ১২ বা ১৩ যিলহজ্জ (ইয়াওমুত তাশরীক ও বিদায়)
১২ ও ১৩ যিলহজ্জ তাশরীকের দ্বিতীয় ও তৃতীয় দিন। এই দিনগুলো হজ্জের সমাপ্তি পর্যায় এবং মক্কা ত্যাগের প্রস্তুতির সময়। নিয়মগুলো হলো:
- জামারাতে পাথর নিক্ষেপ: ১১ যিলহজ্জের মতো ১২ যিলহজ্জেও তিনটি জামরায় ৭টি করে মোট ২১টি কংকর নিক্ষেপ করা হয়। এটি জোহরের পর থেকে সূর্যাস্তের মধ্যে করা হয়। কেউ ইচ্ছা করলে ১৩ যিলহজ্জেও একইভাবে পাথর নিক্ষেপ করতে পারেন, যা অতিরিক্ত ইবাদত হিসেবে গণ্য হয়।
- মিনা ত্যাগ: ১২ যিলহজ্জে পাথর নিক্ষেপের পর হাজিরা মিনা ত্যাগ করে মক্কায় ফিরে যেতে পারেন। তবে, যারা ১৩ যিলহজ্জে থাকতে চান, তারা পাথর নিক্ষেপের পর মক্কায় ফিরেন। ১৩ যিলহজ্জে থাকা উত্তম, কারণ এটি হজ্জের পূর্ণতা বাড়ায়।
- তাওয়াফে বিদা: হজ্জের সমাপ্তি হিসেবে মক্কা ত্যাগের আগে হাজিরা তাওয়াফে বিদা (বিদায়ী তাওয়াফ) করেন। এটি কাবার চারপাশে সাত চক্কর দেওয়া, যা কাবা ও মক্কার প্রতি বিদায়ের প্রতীক। তাওয়াফের পর মাকামে ইব্রাহিমের কাছে দুই রাকাত নামাজ পড়া হয়। মহিলাদের জন্য ঋতুস্রাবের কারণে তাওয়াফে বিদা বাদ দেওয়া জায়েজ।
- জমজম পান ও দোয়া: তাওয়াফে বিদার পর হাজিরা জমজমের পানি পান করেন এবং কাবার দিকে মুখ করে দোয়া করেন। এটি হজ্জের সমাপ্তির একটি আবেগঘন মুহূর্ত।
- মক্কা ত্যাগ: তাওয়াফে বিদার পর হাজিরা মক্কা ত্যাগ করে নিজ নিজ গন্তব্যে ফিরে যান। কেউ কেউ মদিনায় যান রাসূলুল্লাহ (সা.)-এর রওজা জিয়ারতের জন্য।
আধ্যাত্মিক তাৎপর্য:
তাশরীকের শেষ দিনগুলো হজ্জের সমাপ্তি ও আল্লাহর প্রতি কৃতজ্ঞতার সময়। জামরাতে পাথর নিক্ষেপ শয়তানের বিরুদ্ধে প্রতিরোধের ধারাবাহিকতা বজায় রাখে। তাওয়াফে বিদা কাবা ও মক্কার প্রতি গভীর ভালোবাসা ও বিদায়ের প্রতীক। জমজম পান ও দোয়া হজ্জের আধ্যাত্মিক অভিজ্ঞতার সমাপ্তি এবং আল্লাহর রহমতের জন্য কৃতজ্ঞতা প্রকাশ করে। এই দিনগুলো হাজিদের হজ্জের স্মৃতি ও শিক্ষাকে জীবনে ধরে রাখার প্রতিশ্রুতি জাগায়।
ব্যবহারিক পরামর্শ:
- ১২ বা ১৩ যিলহজ্জে পাথর নিক্ষেপের সময় ভিড় এড়াতে সকালে বা বিকেলে যান।
- তাওয়াফে বিদার জন্য সময় বের করুন এবং ভিড়ের কারণে ধৈর্য ধরুন।
- জমজম পানির বোতল সঙ্গে রাখুন এবং তাওয়াফের পর পর্যাপ্ত বিশ্রাম নিন।
- মক্কা ত্যাগের আগে আপনার লাগেজ ও ভ্রমণ নথি প্রস্তুত রাখুন।
- হজ্জের অভিজ্ঞতা নিয়ে একটি ডায়েরি লিখুন, যাতে স্মৃতি সংরক্ষিত থাকে।
হজ্জের নিয়ম পালনের গুরুত্ব
হজ্জের পাঁচ দিনের নিয়ম সঠিকভাবে পালন করা হজ্জের গ্রহণযোগ্যতার জন্য অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ। এই নিয়মগুলো শুধু ধর্মীয় আচার নয়, বরং এর পেছনে গভীর আধ্যাত্মিক ও সামাজিক তাৎপর্য রয়েছে:
- আধ্যাত্মিক শুদ্ধি: আরাফাতে দোয়া, তাওয়াফ, সাঈ ও যিকির হাজিদের হৃদয়কে পরিশুদ্ধ করে এবং তাদের আল্লাহর নৈকট্য লাভে সহায়তা করে।
- ঐক্য ও সমতা: ইহরামের একই ধরনের পোশাক ও মিনায় অবস্থান ধনী-গরিব, উচ্চ-নিম্নের পার্থক্য দূর করে মুসলিমদের মধ্যে ঐক্য সৃষ্টি করে।
- ধৈর্য ও শৃঙ্খলা: মুজদালিফায় রাত্রিযাপন, জামারাতে পাথর নিক্ষেপ ও ভিড়ের মধ্যে তাওয়াফ ধৈর্য ও শৃঙ্খলার শিক্ষা দেয়।
- ত্যাগ ও সমর্পণ: কুরবানি, ইহরামের নিষেধাজ্ঞা মেনে চলা ও তাওয়াফ আল্লাহর জন্য ত্যাগ ও সমর্পণের প্রতীক।
- কৃতজ্ঞতা ও প্রতিফলন: তাশরীকের দিনগুলো ও তাওয়াফে বিদা হাজিদের হজ্জের অভিজ্ঞতার প্রতি কৃতজ্ঞতা ও জীবনে এর শিক্ষা প্রয়োগের প্রতিশ্রুতি জাগায়।
হজ্জ পালনে প্রস্তুতি ও সতর্কতা
হজ্জের নিয়ম সঠিকভাবে পালনের জন্য হাজিদের কিছু প্রস্তুতি ও সতর্কতা গ্রহণ করা উচিত। এগুলো হজ্জকে আরও সহজ ও ফলপ্রসূ করে:
- প্রাক-হজ্জ প্রশিক্ষণ: হজ্জের আগে নিয়ম, নিষিদ্ধ কাজ ও আচার সম্পর্কে বিস্তারিত পড়াশোনা করুন। অনেক দেশে হজ্জ প্রশিক্ষণ কর্মশালা আয়োজিত হয়, যেখানে ব্যবহারিক দিকনির্দেশনা দেওয়া হয়।
- ইহরামের প্রস্তুতি: ইহরামের জন্য সুগন্ধিমুক্ত সাবান, টুথপেস্ট, ক্রিম ও পরিষ্কার পোশাক সংগ্রহ করুন। পুরুষদের জন্য ইজার ও রিদার কাপড় আরামদায়ক ও সঠিক মাপের হওয়া উচিত।
- শারীরিক প্রস্তুতি: হজ্জে অনেক হাঁটাচলা ও শারীরিক পরিশ্রম করতে হয়। তাই হজ্জের আগে নিয়মিত হাঁটা, ব্যায়াম ও স্বাস্থ্যকর খাদ্যাভ্যাস গড়ে তুলুন। প্রয়োজনে ডাক্তারের পরামর্শ নিন।
- মানসিক প্রস্তুতি: হজ্জে ভিড়, গরম ও অপেক্ষার সম্মুখীন হতে হয়। ধৈর্য, শান্তি ও সহনশীলতার মনোভাব গড়ে তুলুন। হজ্জের আধ্যাত্মিক উদ্দেশ্যের উপর মনোযোগ দিন।
- সময়সূচি মেনে চলা: আরাফাত, মুজদালিফা, জামারাত ও তাওয়াফের জন্য নির্ধারিত সময়সূচি মেনে চলুন। সৌদি কর্তৃপক্ষ ও হজ্জ সংস্থার নির্দেশনা অনুসরণ করুন।
- নিষিদ্ধ কাজ এড়ানো: ইহরামের নিষিদ্ধ কাজ সম্পর্কে সচেতন থাকুন এবং সেগুলো এড়িয়ে চলুন। উদাহরণস্বরূপ, সুগন্ধি ব্যবহার না করা, ঝগড়া এড়ানো এবং শরীরের লোম অপসারণ না করা।
- জরুরি সামগ্রী: পর্যাপ্ত পানি, হালকা খাবার, প্রাথমিক চিকিৎসা সামগ্রী, ছাতা, আরামদায়ক জুতা ও একটি ছোট ব্যাগ সঙ্গে রাখুন। মোবাইল চার্জার ও পাওয়ার ব্যাংকও সঙ্গে রাখা উচিত।
- দলের সাথে সমন্বয়: হজ্জ সাধারণত দলবদ্ধভাবে করা হয়। দলের নেতা ও সহযাত্রীদের সাথে সমন্বয় রাখুন এবং তাদের সাথে সহযোগিতা করুন।
হজ্জের ৫ দিনের গাইড সম্পর্কিত প্রায়শই জিজ্ঞাসিত প্রশ্নোত্তর (FAQ)
নিম্নে হজ্জের পাঁচ দিনের নিয়ম এবং এর সাথে সম্পর্কিত কিছু প্রায়শই জিজ্ঞাসিত প্রশ্ন ও তাদের উত্তর দেওয়া হলো। এই FAQ হজ্জ পালনকারীদের জন্য স্পষ্ট দিকনির্দেশনা প্রদান করবে এবং তাদের হজ্জ সঠিকভাবে সম্পন্ন করতে সহায়তা করবে।
হজ্জের পাঁচ দিন কখন শুরু হয় এবং কী কী কার্যক্রম অন্তর্ভুক্ত?
উত্তর: হজ্জের পাঁচ দিন শুরু হয় ৮ যিলহজ্জ এবং সাধারণত ১২ বা ১৩ যিলহজ্জ পর্যন্ত চলে। এই সময়ে হাজিরা নিম্নলিখিত কার্যক্রম সম্পন্ন করেন:
- ৮ যিলহজ্জ: ইহরাম বাঁধা, মিনায় অবস্থান, দোয়া ও যিকির।
- ৯ যিলহজ্জ: আরাফাতে অবস্থান, দোয়া, মুজদালিফায় রাত্রিযাপন, কংকর সংগ্রহ।
- ১০ যিলহজ্জ: জামরাতুল আকাবায় পাথর নিক্ষেপ, কুরবানি, চুল কাটা, তাওয়াফে যিয়ারাত, সাঈ।
- ১১ যিলহজ্জ: তিনটি জামরায় পাথর নিক্ষেপ, মিনায় রাত্রিযাপন, তাকবিরে তাশরীক।
- ১২/১৩ যিলহজ্জ: তিনটি জামরায় পাথর নিক্ষেপ, তাওয়াফে বিদা, মক্কা ত্যাগ।
ইহরাম বাঁধার সময় কী কী প্রস্তুতি নিতে হবে?
উত্তর: ইহরাম বাঁধার আগে নিম্নলিখিত প্রস্তুতি নিন:
- গোসল করুন এবং নখ-চুল পরিপাটি করুন।
- পুরুষদের জন্য দুই টুকরো অসেলাই করা সাদা কাপড় (ইজার ও রিদা) এবং মহিলাদের জন্য পর্দানশীল পোশাক প্রস্তুত করুন।
- সুগন্ধিমুক্ত সাবান, টুথপেস্ট ও ক্রিম ব্যবহার করুন।
- হজ্জের নিয়ত করুন এবং তালবিয়া পড়ুন: "লাব্বাইক আল্লাহুম্মা লাব্বাইক..."।
- ইহরামের নিষিদ্ধ কাজ (যেমন সুগন্ধি, চুল কাটা) সম্পর্কে সচেতন থাকুন।
আরাফাতে অবস্থান না করলে কী হয়?
উত্তর: আরাফাতে অবস্থান (ওকুফে আরাফা) হজ্জের সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ আচার এবং এটি বাধ্যতামূলক। এটি ছাড়া হজ্জ পূর্ণ হয় না। যদি কেউ জরুরি কারণে (যেমন অসুস্থতা) আরাফাতে যেতে না পারেন, তবে তাদের পরবর্তী বছর হজ্জ পুনরায় করতে হতে পারে। তাই এই দিনে আরাফাতে উপস্থিত থাকা নিশ্চিত করুন।
মুজদালিফায় রাত্রিযাপনের গুরুত্ব কী?
উত্তর: মুজদালিফায় ৯ যিলহজ্জের রাত কাটানো হজ্জের একটি গুরুত্বপূর্ণ আচার। এটি ধৈর্য, সরলতা ও আল্লাহর প্রতি নির্ভরতার শিক্ষা দেয়। খোলা আকাশের নিচে থাকা হাজিদের আধ্যাত্মিক অভিজ্ঞতাকে গভীর করে। এই সময়ে মাগরিব ও ইশার নামাজ একসাথে পড়া হয় এবং পরবর্তী দিনের জন্য কংকর সংগ্রহ করা হয়।
জামারাতে পাথর নিক্ষেপের সঠিক পদ্ধতি কী?
উত্তর: জামারাতে পাথর নিক্ষেপের পদ্ধতি:
- ১০ যিলহজ্জ: শুধু জামরাতুল আকাবা (বড় জামরা) এ ৭টি কংকর নিক্ষেপ করুন।
- ১১ ও ১২ যিলহজ্জ: তিনটি জামরা (ছোট, মাঝারি, বড়) তে ৭টি করে মোট ২১টি কংকর নিক্ষেপ করুন।
- প্রতিটি কংকর নিক্ষেপের সময় "আল্লাহু আকবার" বলুন।
- কংকর ছোট (মসুর ডালের আকার) হতে হবে এবং নির্দিষ্ট জায়গায় নিক্ষেপ করতে হবে।
- ভিড় এড়াতে সকালে বা বিকেলে নিক্ষেপ করুন এবং নির্দেশিত পথ মেনে চলুন।
কুরবানি কার জন্য বাধ্যতামূলক এবং এটি কীভাবে সম্পন্ন হয়?
উত্তর: হজ্জে তামাত্তু বা কিরান পালনকারীদের জন্য কুরবানি বাধ্যতামূলক। এটি সাধারণত একটি ছাগল, ভেড়া বা গরুর এক-সপ্তমাংশ। আধুনিক সময়ে সৌদি কর্তৃপক্ষ কুরবানির ব্যবস্থা করে। হাজিরা কুরবানির ভাউচার কিনে এই দায়িত্ব পালন করেন, এবং মাংস গরিবদের মধ্যে বিতরণ করা হয়। কুরবানি ১০ যিলহজ্জে জামরাতে পাথর নিক্ষেপের পর করা হয়।
তাওয়াফে যিয়ারাত কখন করতে হয় এবং এর গুরুত্ব কী?
উত্তর: তাওয়াফে যিয়ারাত হজ্জের একটি প্রধান আচার এবং এটি ১০ থেকে ১২ যিলহজ্জের মধ্যে করতে হয়। এটি কাবার চারপাশে সাত চক্কর দেওয়া, যা কাবার প্রতি ভালোবাসা ও আল্লাহর ঘরের চারপাশে ঐক্যের প্রতীক। তাওয়াফের পর মাকামে ইব্রাহিমের কাছে দুই রাকাত নামাজ পড়া হয়। এটি হজ্জের পূর্ণতার জন্য অপরিহার্য।
সাঈ কী এবং এটি কখন করা হয়?
উত্তর: সাঈ হলো সাফা ও মারওয়া পাহাড়ের মধ্যে সাতবার হাঁটা, যা হযরত হাজেরা (আ.)-এর পানির সন্ধানে দৌড়ানোর স্মরণ করায়। এটি তাওয়াফে যিয়ারাতের পর ১০ যিলহজ্জে করা হয়, তবে হজ্জে তামাত্তুর ক্ষেত্রে উমরার সময়ও করা যেতে পারে। সাঈ-এর সময় দোয়া ও যিকির করা হয়।
তাওয়াফে বিদা কেন করা হয় এবং কার জন্য এটি বাধ্যতামূলক?
উত্তর: তাওয়াফে বিদা হলো মক্কা ত্যাগের আগে কাবার চারপাশে সাত চক্কর দেওয়া, যা কাবা ও মক্কার প্রতি বিদায়ের প্রতীক। এটি ১২ বা ১৩ যিলহজ্জে করা হয়। এটি সব হাজির জন্য বাধ্যতামূলক, তবে ঋতুস্রাবের কারণে মহিলারা এটি বাদ দিতে পারেন। তাওয়াফের পর জমজম পানি পান ও দোয়া করা হয়।
তাশরীকের দিনগুলো কী এবং এই সময়ে কী করতে হয়?
উত্তর: তাশরীকের দিনগুলো হলো ১১, ১২ ও ১৩ যিলহজ্জ। এই সময়ে হাজিরা:
- তিনটি জামরায় ৭টি করে কংকর নিক্ষেপ করেন।
- প্রতি ফরজ নামাজের পর তাকবিরে তাশরীক পড়েন: "আল্লাহু আকবার, আল্লাহু আকবার..."।
- মিনায় তাঁবুতে রাত কাটান এবং দোয়া-যিকিরে সময় কাটান। এই দিনগুলো আল্লাহর শুকরিয়া ও যিকিরের সময়।
হজ্জের সময় ভিড় ও গরম মোকাবিলা করার উপায় কী?
উত্তর: ভিড় ও গরম মোকাবিলার জন্য:
- পর্যাপ্ত পানি ও হালকা খাবার সঙ্গে রাখুন।
- ছাতা বা টুপি (মহিলাদের জন্য) ব্যবহার করুন।
- আরামদায়ক জুতা পরুন এবং হাঁটাচলার জন্য প্রস্তুত থাকুন।
- ভিড়ে ধৈর্য ধরুন এবং নির্দেশিত পথ মেনে চলুন।
- সকালে বা বিকেলে জামরাতে পাথর নিক্ষেপ করুন, যখন ভিড় কম থাকে।
হজ্জে নিষিদ্ধ কাজগুলো কী কী?
উত্তর: ইহরামের সময় নিষিদ্ধ কাজগুলো হলো:
- সুগন্ধি ব্যবহার (পারফিউম, সুগন্ধযুক্ত সাবান)।
- চুল বা নখ কাটা, শরীরের লোম অপসারণ।
- পুরুষদের জন্য সেলাই করা পোশাক বা মাথা ঢাকা।
- যৌন সম্পর্ক, চুম্বন বা যৌন উত্তেজনা সৃষ্টিকারী কথা।
- শিকার করা বা গাছপালা কাটা।
- ঝগড়া, গালাগালি বা অশ্লীল কথাবার্তা।
হজ্জের জন্য শারীরিক ও মানসিক প্রস্তুতি কীভাবে নেব?
উত্তর: শারীরিক ও মানসিক প্রস্তুতির জন্য:
- নিয়মিত হাঁটা, ব্যায়াম ও স্বাস্থ্যকর খাদ্যাভ্যাস গড়ে তুলুন।
- হজ্জের আগে ডাক্তারের পরামর্শ নিন এবং প্রয়োজনীয় টিকা নিন।
- হজ্জের নিয়ম ও নিষিদ্ধ কাজ সম্পর্কে পড়াশোনা করুন।
- ধৈর্য, শান্তি ও সহনশীলতার মনোভাব গড়ে তুলুন।
- হজ্জের আধ্যাত্মিক উদ্দেশ্যের উপর মনোযোগ দিন এবং দোয়ার তালিকা তৈরি করুন।
হজ্জের সময় জরুরি সামগ্রী কী কী সঙ্গে রাখতে হবে?
উত্তর: জরুরি সামগ্রী হলো:
- পর্যাপ্ত পানি ও হালকা খাবার (যেমন খেজুর, বিস্কুট)।
- সুগন্ধিমুক্ত সাবান, টুথপেস্ট, ক্রিম।
- আরামদায়ক জুতা, ছাতা, হালকা কম্বল।
- প্রাথমিক চিকিৎসা সামগ্রী (ব্যান্ডেজ, পেইনকিলার)।
- মোবাইল চার্জার, পাওয়ার ব্যাংক, ছোট দোয়ার বই।
- কংকর সংগ্রহের জন্য ছোট ব্যাগ।
হজ্জের পাঁচ দিনের আধ্যাত্মিক তাৎপর্য কী?
উত্তর: হজ্জের পাঁচ দিনের আধ্যাত্মিক তাৎপর্য হলো:
- ইহরাম: দুনিয়াবি সবকিছু থেকে বিচ্ছিন্ন হয়ে আল্লাহর জন্য নিজেকে উৎসর্গ করা।
- আরাফাতে অবস্থান: তওবা, ক্ষমা প্রার্থনা ও আল্লাহর রহমত লাভ।
- জামরাতে পাথর নিক্ষেপ: শয়তানের প্রলোভন প্রত্যাখ্যান ও আল্লাহর প্রতি আনুগত্য।
- কুরবানি: ত্যাগ ও সমর্পণের শিক্ষা।
- তাওয়াফ ও সাঈ: কাবার প্রতি ভালোবাসা, ঐক্য ও ধৈর্যের প্রতীক।
- তাওয়াফে বিদা: কাবা ও মক্কার প্রতি বিদায় ও কৃতজ্ঞতা।
হজ্জে দলের সাথে সমন্বয় কেন গুরুত্বপূর্ণ?
উত্তর: হজ্জ সাধারণত দলবদ্ধভাবে করা হয়, এবং দলের সাথে সমন্বয় গুরুত্বপূর্ণ কারণ:
- দলের নেতা সময়সূচি, পরিবহন ও থাকার ব্যবস্থা পরিচালনা করেন।
- ভিড়ে হারিয়ে যাওয়া বা বিভ্রান্তি এড়াতে দলের সাথে থাকা নিরাপদ।
- সহযাত্রীদের সাথে সহযোগিতা হজ্জের অভিজ্ঞতাকে আরও সহজ ও আনন্দদায়ক করে।
- দলের সদস্যরা একে অপরকে সাহায্য করতে পারেন, যেমন দোয়া মনে করিয়ে দেওয়া বা জিনিসপত্র শেয়ার করা।
এই FAQ হজ্জ পালনকারীদের পাঁচ দিনের নিয়ম সম্পর্কে স্পষ্ট ধারণা দেবে এবং তাদের হজ্জ সঠিকভাবে সম্পন্ন করতে সহায়তা করবে। যেকোনো সন্দেহ থাকলে স্থানীয় আলেম, হজ্জ প্রশিক্ষক বা হজ্জ সংস্থার সাথে পরামর্শ করুন।
হজ্জের পাঁচ দিনের গাইড হাজিদের জন্য একটি পূর্ণাঙ্গ দিকনির্দেশনা, যা তাদের হজ্জ সঠিকভাবে সম্পন্ন করতে সহায়তা করে। প্রতিটি দিনের নিয়ম, যেমন ইহরাম বাঁধা, আরাফাতে অবস্থান, জামারাতে পাথর নিক্ষেপ, কুরবানি, তাওয়াফ ও সাঈ, হজ্জের আধ্যাত্মিক ও ধর্মীয় মর্যাদা বৃদ্ধি করে।
এই নিয়মগুলোর পেছনে ত্যাগ, ঐক্য, ধৈর্য, শৃঙ্খলা ও আল্লাহর প্রতি সমর্পণের গভীর তাৎপর্য রয়েছে। হাজিদের জন্য এই নিয়মগুলো মনোযোগ দিয়ে পালন করা এবং নিষিদ্ধ কাজ এড়িয়ে চলা অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ, যাতে তাদের হজ্জ আল্লাহর কাছে কবুল হয়। এই নিবন্ধে আলোচিত নিয়ম, আধ্যাত্মিক তাৎপর্য ও ব্যবহারিক পরামর্শ হাজিদের জন্য একটি পথপ্রদর্শক হিসেবে কাজ করবে, যা তাদের হজ্জকে আরও অর্থবহ ও ফলপ্রসূ করবে।
হজ্জ শুধু একটি ধর্মীয় আচার নয়, বরং এটি জীবনের একটি রূপান্তরকারী অভিজ্ঞতা, যা হাজিদের আল্লাহর সাথে সম্পর্ককে গভীর করে এবং তাদের জীবনে নতুন শুরুর সুযোগ দেয়।