ইসলাম একটি পূর্ণাঙ্গ জীবন ব্যবস্থা, যার প্রতিটি নির্দেশনার পেছনে রয়েছে ঐশী প্রজ্ঞা ও মানব জীবনের কল্যাণ। মুসলমানদের জন্য হজ একটি ফরজ ইবাদত হলেও, তার পাশাপাশি একটি অতীব গুরুত্বপূর্ণ সুন্নত ইবাদত হলো ওমরাহ।
যদিও ওমরাহ হজের মতো বাধ্যতামূলক নয়, তবে এর তাৎপর্য, মাহাত্ম্য ও ইতিহাস এতটাই গভীর যে, একজন ঈমানদার মুসলমানের অন্তরে এই ইবাদতের প্রতি এক গভীর আকর্ষণ ও শ্রদ্ধা জন্ম নেয়। এই ব্লগে আমরা ওমরাহর উৎপত্তি, ঐতিহাসিক পটভূমি এবং একজন মুমিনের ঈমানী চেতনার আলোকে এর তাৎপর্য বিশ্লেষণ করবো।
ওমরাহ ইসলামী শরিয়তে একটি গুরুত্বপূর্ণ ইবাদত, যার মাধ্যমে একজন মুসলমান পবিত্র কাবা শরিফে উপস্থিত হয়ে কিছু নির্ধারিত কর্মপদ্ধতি পালন করেন। আরবি শব্দ "উমরাহ" (عُمْرَة) এর আভিধানিক অর্থ হলো “পরিদর্শন” বা “ভ্রমণ”। তবে ইসলামী পরিভাষায় ওমরাহ বলতে বোঝায় ইহরাম গ্রহণ করে, কাবা শরিফ তাওয়াফ, সাফা ও মারওয়ার মাঝে সাঈ এবং শেষে চুল কাটা বা ছাঁটা করে ইহরাম মুক্ত হওয়া।
এটি একটি স্বতন্ত্র ইবাদত, যা হজের মতো হলেও হজের মতো বাধ্যতামূলক নয় এবং নির্দিষ্ট সময়েও সীমাবদ্ধ নয়।
ওমরাহ আদায় করা যায় বছরের যেকোনো সময়, হজের নির্দিষ্ট কয়েকটি দিন ছাড়া। এটি রাসূলুল্লাহ (সা.)-এর প্রিয় সুন্নাহর অন্তর্ভুক্ত, এবং তিনি জীবদ্দশায় চারবার ওমরাহ আদায় করেন। কোরআন ও হাদীসে ওমরাহ পালনের উৎসাহ দেয়া হয়েছে।
আল্লাহ তায়ালা কুরআনে ইরশাদ করেন:
"আর আল্লাহর সন্তুষ্টির জন্য হজ ও ওমরাহ সম্পন্ন করো..." (সূরা আল-বাকারা, আয়াত ১৯৬)
ওমরাহ শুধুমাত্র একটি শারীরিক ও আচারগত ইবাদত নয়, বরং এটি আত্মশুদ্ধির এক অসাধারণ সুযোগ। ওমরাহ পালনকারী ব্যক্তি নিজেকে গুনাহ থেকে মুক্ত করতে, নতুনভাবে শুরু করতে এবং আল্লাহর রহমতের দ্বারে নিজেকে সমর্পণ করতে পারে।
হাদীসে এসেছে,
“এক ওমরাহ থেকে আরেক ওমরাহর মধ্যকার সময়ে যেসব গুনাহ হয়, তা ক্ষমা করে দেয়া হয়।” (সহীহ বুখারী)
ঐতিহাসিকভাবে, ওমরাহ শুধু ইবাদতের মাধ্যমই নয়, বরং ইসলামি পরিচয়, ঐক্য এবং আত্মিক শক্তির বহিঃপ্রকাশও বটে। প্রথম ইসলামী ওমরাহ, যা "ওমরাতুল ক্বাযা" নামে পরিচিত, ইসলামের রাজনৈতিক ও কূটনৈতিক বিজয়ের এক অনন্য উদাহরণ।
আজও বিশ্বের লক্ষ লক্ষ মুসলমান, প্রত্যেক বছর, ওমরাহর মাধ্যমে পবিত্র কাবার সামনে দাঁড়িয়ে আল্লাহর দরবারে কান্নাকাটি করে, নিজের পাপ মাফ চায় এবং ঈমানকে নতুনভাবে জাগ্রত করে তোলে। তাই, ওমরাহ শুধুই একটি ইবাদত নয় বরং এটি আত্মার সফর, হৃদয়ের বিপ্লব এবং জীবনের এক পবিত্র বাঁক।
ইসলামের ইতিহাসে ওমরাহ ও হজ এই দুই ইবাদতের কেন্দ্রবিন্দু হলো পবিত্র কাবা শরিফ। এই ঘরটি সর্বপ্রথম নির্মাণ করেন আল্লাহর ঘনিষ্ঠ নবী হযরত ইব্রাহিম (আ.) ও তাঁর পুত্র হযরত ইসমাইল (আ.)। আল্লাহ তাআলা কুরআনে বলেন:
“আর মানুষের মধ্যে হজের ঘোষণা দাও, তারা তোমার কাছে আসবে পায়ে হেঁটে এবং প্রতিটি ক্ষীণকায় উটের পিঠে চড়ে—যারা প্রত্যন্ত পথ পাড়ি দিয়ে আসবে।” (সূরা হজ্জ, আয়াত ২৭)
এই আয়াতে যে “হজের ঘোষণা” বলা হয়েছে, তা ছিল একটি আধ্যাত্মিক ডাকে পরিণত, যা কেয়ামত পর্যন্ত হজ ও ওমরাহর আহ্বান রূপে জারি থাকবে। যদিও তখন "ওমরাহ" শব্দটি নির্দিষ্টভাবে ব্যবহৃত হয়নি, তবে আল্লাহর ঘর জিয়ারত এবং আনুষ্ঠানিকভাবে কিছু নির্দিষ্ট ইবাদত পালনের ধারণা তখন থেকেই শুরু হয়।
এই পবিত্র ঘর নির্মাণের সময় হযরত ইব্রাহিম (আ.) ও ইসমাইল (আ.) এর দোয়া ছিল:
"হে আমাদের পালনকর্তা! আমাদের থেকে তা কবুল করে নাও, নিশ্চয়ই তুমি সর্বশ্রোতা, সর্বজ্ঞানী।" (সূরা বাকারা, আয়াত ১২৭)
হযরত ইব্রাহিম (আ.) ও ইসমাইল (আ.)-এর পরবর্তী কয়েক শতাব্দী পর্যন্ত এই ঘর ও ইবাদতের ঐতিহ্য কোনোমতে টিকে ছিল। তবে সময়ের প্রবাহে আরবরা তাওহীদের পথ হারিয়ে পৌত্তলিকতায় নিমজ্জিত হয়। তারা কাবার চারপাশে স্থাপন করে ৩৬০টি মূর্তি। কাবা, যা ছিল একেশ্বরবাদ ও পবিত্রতার প্রতীক, তা মূর্তিপূজা, কুসংস্কার ও ধর্মীয় বিকৃতির কেন্দ্রবিন্দুতে পরিণত হয়।
তারা কিছু আকারে ওমরাহর মতো কিছু কার্যকলাপ বজায় রাখলেও তা ছিল বিকৃত, যেমন:
এসব প্রথা ইসলামের মূলনীতির সম্পূর্ণ বিপরীত। কাবার সম্মান ও পবিত্রতা যেখানে একেশ্বরবাদ, আত্মশুদ্ধি ও বিনয় প্রদর্শনের প্রতীক, সেখানে তারা একে বানিয়ে তোলে একটি সামাজিক ও অর্থনৈতিক পূজা কেন্দ্র।
এই অন্ধকারময় যুগে, যখন তাওহীদ ধ্বংসপ্রাপ্ত, মানবতা বিভ্রান্ত এবং ধর্মীয় সত্য বিকৃত হয়ে পড়েছে তখন হিজাজের মরুভূমিতে আবির্ভূত হন শেষ নবী, হযরত মুহাম্মদ (সা.)। তিনি ৬১০ খ্রিষ্টাব্দে নবুওয়ত প্রাপ্ত হন এবং মানুষের মাঝে তাওহীদের আহ্বান শুরু করেন। তার নবুওয়ত ছিল কেবল শব্দে নয়, বরং কাজেও কাবার পবিত্রতা ফিরিয়ে আনার চেষ্টায় পরিপূর্ণ।
মক্কায় অত্যাচার সহ্য করে ইসলামের বীজ রোপণ করার পর রাসূল (সা.) হিজরত করেন মদিনায়। সেখানে একটি সুসংগঠিত মুসলিম সমাজ প্রতিষ্ঠা হয়। এরপর হিজরি ৬ সনে রাসূল (সা.) সাহাবিদের নিয়ে ওমরাহর উদ্দেশ্যে মক্কা অভিমুখে যাত্রা করেন। যদিও কুরাইশরা বাধা দেয়, এবং সংঘর্ষ এড়াতে হুদাইবিয়ার সন্ধি স্বাক্ষরিত হয় যার অন্যতম গুরুত্বপূর্ণ শর্ত ছিল, “পরের বছর মুসলমানরা মক্কায় প্রবেশ করে ওমরাহ পালন করবে”।
এই চুক্তির ফলেই হিজরি ৭ সনে মুসলিমরা শান্তিপূর্ণভাবে প্রথম ইসলামী ওমরাহ আদায় করেন, যা ইসলামী ইতিহাসে “ওমরাতুল ক্বাযা” নামে পরিচিত। এটি ছিল ওমরাহর পূর্ণ পুনরুজ্জীবন, যা ইসলামের মূল শিক্ষা অনুসারে সম্পন্ন হয়েছিল ইহরাম, তাওয়াফ, সাঈ ও তাহাল্লুল সহ সকল বিধান মেনে।
এই ঐতিহাসিক পটভূমিই আমাদের শেখায় ওমরাহ কেবল একটি রিচুয়াল নয়, এটি হচ্ছে এক পবিত্র আন্দোলন, যা শুরু হয়েছিল ইব্রাহিম (আ.)-এর হাতে, বিকৃত হয়েছিল জাহেলিয়াতের যুগে, এবং পুনর্জাগরিত হয়েছিল মুহাম্মদ (সা.)-এর মাধ্যমে।
প্রথম ইসলামী ওমরাহ ছিল হিজরি ৭ সনের জিলকদ মাসে সংঘটিত একটি ঐতিহাসিক ইবাদত, যা “ওমরাতুল ক্বাযা” নামে পরিচিত। এর পেছনের মূল প্রেক্ষাপট ছিল হুদাইবিয়ার সন্ধি। হিজরি ৬ সালে রাসূলুল্লাহ (সা.) ও ১৪০০ সাহাবি ওমরাহর উদ্দেশ্যে মক্কা গিয়েও কুরাইশদের বাধায় তা সম্পন্ন করতে পারেননি। পরে উভয় পক্ষের মধ্যে চুক্তি হয় যে, পরের বছর মুসলমানরা তিন দিনের জন্য কাবায় প্রবেশ করে ওমরাহ করতে পারবে।
হিজরি ৭ সালে রাসূলুল্লাহ (সা.) ২০০০ সাহাবিকে নিয়ে মক্কায় প্রবেশ করেন, তাওয়াফ, সাঈ এবং তাহাল্লুল করে শান্তিপূর্ণভাবে ওমরাহ আদায় করেন। কুরাইশরা সেই সময় শহরের বাইরে চলে যায়।
এই ওমরাহ ছিল ইসলামের ইতিহাসে প্রথমবার কাবা শরিফে মুসলমানদের মর্যাদার সাথে প্রবেশ, যা ইসলামের রাজনৈতিক ও ধর্মীয় প্রতিষ্ঠাকে নতুন এক স্তরে নিয়ে যায়।
একজন ঈমানদার ব্যক্তি ওমরাহকে কেবল ভ্রমণ বা আচার-অনুষ্ঠান হিসেবে দেখেন না, বরং এটি তাঁর আত্মার পরিশুদ্ধি, আল্লাহর নৈকট্য লাভ ও গুনাহ মাফের এক সুবর্ণ সুযোগ হিসেবে দেখেন।
রাসূল (সা.) বলেন:
“এক ওমরাহ থেকে আরেক ওমরাহ দু’টির মধ্যবর্তী সময়ের গুনাহসমূহের কাফফারা।” (বুখারী ও মুসলিম)
এ হাদীস স্পষ্ট করে দেয় যে ওমরাহ কেবল শরীরিক শ্রম নয়, বরং আত্মিক পরিশুদ্ধি।
ইহরাম গ্রহণের মাধ্যমে একজন মুসলমান দুনিয়ার ভোগ-বিলাস থেকে নিজেকে দূরে রাখে। এতে আত্মসংযম, ধৈর্য, সহানুভূতি ও তাকওয়া চর্চা হয়।
ওমরাহর সময় বিশ্বের নানা প্রান্ত থেকে আগত মুসলিমরা একত্রিত হন। এতে সৃষ্টি হয় এক বৈশ্বিক ঐক্যের পরিবেশ, যা মুসলিম উম্মাহকে শক্তিশালী করে।
অনেকের মনে প্রশ্ন জাগেওমরাহ যদি এতই গুরুত্বপূর্ণ হয়, তবে হজের সঙ্গে এর পার্থক্য কী?
বিষয় | হজ | ওমরাহ |
ফরজ/সুন্নত | ফরজ | সুন্নত |
সময় | নির্দিষ্ট | বছরের যেকোনো সময় |
রোকন | বেশি | তুলনামূলক কম |
বাধ্যতামূলক শর্ত | একবার জীবনে | বাধ্যতামুলক নয় |
তবে এই পার্থক্য সত্ত্বেও, ওমরাহ হজের এক অনুপম প্রস্তুতি হিসেবেও কাজ করে।।
ওমরাহ কেবল কিছু আনুষ্ঠানিকতা বা রুকনের সমষ্টি নয়, বরং প্রতিটি ধাপই ইসলামের ইতিহাসের এক একটি স্বর্ণালী অধ্যায়। এগুলো বিশ্বাস, ত্যাগ, ভালোবাসা ও আল্লাহর প্রতি সম্পূর্ণ আত্মসমর্পণের প্রতীক।
ইতিহাসের পটভূমি:
ইহরাম ইসলামী শরীয়তের একটি গুরুত্বপূর্ণ অংশ হলেও এর উৎপত্তি নবী ইব্রাহিম (আ.) এর সময় থেকেই। হজ ও ওমরাহর জন্য বিশেষভাবে প্রস্তুতি নেওয়ার এই ধারণা আসে তখন থেকেই। তবে আরবের জাহেলিয়াত যুগে এই রেওয়াজ অনেকটাই বিকৃত হয়ে গিয়েছিল। তারা ইহরাম পালন করতো বটে, কিন্তু অশ্লীলতা, নগ্নতা ও মূর্তি পূজার মতো কাজেও লিপ্ত হতো।
ইসলাম এসে এই বিকৃত রীতি সংশোধন করে। রাসূল (সা.) স্পষ্টভাবে শিক্ষা দেন যে ইহরাম মানে হলো, নিজেকে আল্লাহর সন্তুষ্টির জন্য উৎসর্গ করা। পোশাকের রঙ, আকৃতি ও ব্যবহার নির্ধারণ করে দেন নবীজি (সা.) নিজে।
ঈমানী তাৎপর্য:
ইহরামের সাদা কাপড় সবার জন্য একরকম, যেন দুনিয়ার সকল বৈষম্য বিলীন হয়ে যায়। ধনী, গরিব, রাজা, প্রজা সবাই আল্লাহর দরবারে এক ও অভিন্ন।
“ইহরাম হলো এক হৃদয়ের নিঃস্বতা, আত্মার আত্মসমর্পণ এবং জীবনের বাকি অংশ আল্লাহর পথে অর্পণের ঘোষণা।”
এই অবস্থায় মুসলমান অনেক কিছু হারাম করে, যেমন ঝগড়া, দুশ্চিন্তা, গীবত, যৌন সম্পর্ক, এমনকি গাছপালা উপড়ানোও। এটা মূলত এক ‘সোশ্যাল ফাস্ট’ সমাজ ও আত্মার জন্য।
ইতিহাসের শেকড়:
তাওয়াফের ইতিহাস হাজার বছরের পুরোনো। কাবা নির্মাণের সময় হযরত ইব্রাহিম (আ.) এবং ইসমাইল (আ.) আল্লাহর আদেশে ঘরের চারপাশে ঘুরে ঘুরে তা পবিত্র করেন। এই ঘর আল্লাহ নিজে ঘোষণা করেছেন
"এটি পৃথিবীতে মানুষের জন্য প্রথম ইবাদতের ঘর।” (সূরা আলে ইমরান: ৯৬)
এরপর কাবার চারপাশে তাওয়াফ করা শুরু হয়। মক্কার জাহেলিয়াত যুগেও তাওয়াফ ছিল, তবে নগ্ন অবস্থায়, বিভিন্ন মূর্তির সামনে, বিকৃত রীতিতে। ইসলাম এসে এসব দূর করে প্রকৃত তাওয়াফের সংজ্ঞা দেয়।
ঈমানী তাৎপর্য:
তাওয়াফ একটি প্রেমের প্রকাশ। কাবার চারপাশে সাতবার ঘোরা মানে আল্লাহর দিকে আত্মার ঘূর্ণন। ঠিক যেমন পৃথিবী সূর্যের চারপাশে ঘোরে, তেমনি মুমিন হৃদয় ঘোরে আল্লাহর ঘরের চারপাশে।
তাওয়াফের প্রতিটি চক্কর একজন মুমিনের জীবনের একেকটি স্তর: জন্ম, কৈশোর, যৌবন, মধ্যবয়স, বার্ধক্য, মৃত্যু এবং পরকাল। এই ঘূর্ণনের মাঝে থাকে দোয়া, চোখের পানি, আশা আর পরিতাপ।
ঐতিহাসিক পটভূমি:
সাঈ-এর ইতিহাস খুবই আবেগঘন। হযরত ইব্রাহিম (আ.) আল্লাহর নির্দেশে তাঁর স্ত্রী হাজেরা (আ.) ও শিশু ইসমাইল (আ.)-কে রেখে আসেন এক জনমানবহীন মরুভূমিতে। কিছু পানি ও খেজুর রেখে তিনি চলে যান। এক সময় শিশুটি কান্না করতে থাকে। মা হাজেরা তখন পানির সন্ধানে ছোটেন সাফা ও মারওয়ার পাহাড়ের মাঝে।
তিনি একবার সাফা থেকে মারওয়ার, আবার মারওয়ার থেকে সাফা এইভাবে সাতবার দৌড়ান। তাঁর এই ঈমান, ত্যাগ ও আত্মবিশ্বাসের পুরস্কারস্বরূপ আল্লাহ জমজম কূপের মাধ্যমে চিরন্তন পানির উৎস দেন।
ঈমানী তাৎপর্য:
সাঈ মানে দৌড় কিন্তু শুধু শারীরিক নয়, এটি ঈমানের দৌড়। মা হাজেরার মতো আজও প্রতিটি মুসলমান নিজের জীবনের কঠিন পরিস্থিতিতে সাঈ করেন আল্লাহর উপর ভরসা রেখে।
সাঈ আমাদের শিক্ষা দেয় কখনও আল্লাহর রহমতের আশা ছাড়তে নেই। একজন নারী, একা মরুভূমিতে দৌড়াচ্ছেন, আর তাঁর এই দৌড় আজ কোটি মানুষের জন্য ইবাদতের অংশ।
ঐতিহাসিক মূল্য:
মাকামে ইব্রাহিম সেই পাথর, যার ওপর দাঁড়িয়ে হযরত ইব্রাহিম (আ.) কাবার দেওয়াল তুলেছিলেন। কাহিনী অনুসারে, যখন দেয়াল উঁচু হয়ে গেল, তখন ইসমাইল (আ.) তাঁকে একটি পাথর এনে দেন। তিনি সেটির ওপর দাঁড়িয়ে কাজ চালিয়ে যান, আর সেই পাথরের ওপর পড়ে তাঁর পদচিহ্ন, যা আজও সংরক্ষিত আছে।
তাৎপর্য:
এই পদচিহ্ন আমাদের বলে, “তোমার কাজ আল্লাহ দেখেন, সংরক্ষণ করেন এবং তার কদরও করেন।” আমাদের দুনিয়ার কাজের প্রতিফল আমরা না দেখলেও, আল্লাহ দেখেন, এবং তা ফলপ্রসূ হয়।
ইতিহাসের উৎস:
যখন হাজেরা (আ.) দৌড়াচ্ছিলেন এবং ইসমাইল (আ.) কান্না করছিলেন, তখন আল্লাহর হুকুমে জিবরাইল (আ.) এসে তাঁর গোড়ালির আঘাতে মাটির নিচ থেকে পানি বের করে দেন। এই পানিই আজকের জমজম।
এই কূপ ৪০০০ বছর ধরে অক্ষয়। এটি মক্কার সবচেয়ে পবিত্র পানি, যা ওমরাহ ও হজে আসা মানুষরা পান করে, নিয়ে যায় এবং দোয়া করে।
তাৎপর্য:
এটি ঈমানের পুরস্কার। হাজেরা (আ.) প্রমাণ করেন, আল্লাহর প্রতি বিশ্বাস থাকলে মরুভূমিতেও ঝর্ণা ফোটে।
ঐতিহাসিক প্রেক্ষাপট:
ওমরাহ বা হজের শেষে ইহরাম থেকে মুক্তির প্রতীক হিসেবে চুল কাটার রেওয়াজ চালু করেন রাসূল (সা.)। সাহাবিরা হজ ও ওমরাহ শেষে নিজেরা চুল কাটতেন এবং একে অপরকে সাহায্য করতেন।
তাৎপর্য:
চুল কাটা মানে নিজের সৌন্দর্যের অহংকার ত্যাগ করা। একজন মুসলমান এই মাধ্যমে বোঝান “হে আল্লাহ! আমি তোমার সন্তুষ্টির জন্য নিজের দেহ, মস্তিষ্ক, রূপ, আত্মা সব কিছু উৎসর্গ করলাম।”
এটি ওমরাহর শেষ ধাপ হলেও, এটি এক নতুন আত্মিক জীবনের সূচনা।
ওমরাহর প্রতিটি রুকন বা ধাপ আমাদের ইতিহাসের সঙ্গে সংযুক্ত এবং ঈমানের পরিপূর্ণ প্রতিফলন। একে একে এই ধাপগুলো পার হওয়া মানে কেবল নির্দিষ্ট কিছু কাজ সম্পন্ন করা নয় বরং এক ঐতিহাসিক, আত্মিক ও ঈমানি সফর সম্পন্ন করা।
প্রতিটি ধাপে আল্লাহর একজন নবীর জীবন ও ত্যাগ, একজন মায়ের কান্না ও আশা, একজন বান্দার আত্মসমর্পণ ও আত্মশুদ্ধি লুকিয়ে আছে।
বর্তমানে প্রযুক্তির কারণে ওমরাহ অনেক সহজ হয়েছে। অনলাইনে নিবন্ধন, ই-ভিসা, হজ অ্যাপ, গাইডেড সফর ইত্যাদির ফলে আরও সুশৃঙ্খলভাবে ওমরাহ সম্পন্ন করা সম্ভব। কিন্তু প্রযুক্তি যতই আসুক, ওমরাহর আত্মিক গুরুত্ব অপরিবর্তনীয়।
ওমরাহ কোনো আনুষ্ঠানিক ভ্রমণ নয় বরং এটি একটি ঈমানী সফর। একজন মুমিন যখন ওমরাহ পালনের নিয়তে কাবার দিকে পা বাড়ায়, তখন আল্লাহর কাছে সে হয়ে ওঠে এক প্রিয় মেহমান। এই সফরের মাধ্যমে তার হৃদয় আলোকিত হয়, গুনাহ ঝরে পড়ে, আত্মা পায় প্রশান্তি।
ওমরাহর ইতিহাস আমাদের শিক্ষা দেয় আল্লাহর পথে ত্যাগ, ধৈর্য ও বিশ্বাস কখনো বৃথা যায় না। আর ঈমানের আলোয় উদ্ভাসিত হৃদয়ই পারে কাবার রূপে আল্লাহর ঘনিষ্ঠতা অনুভব করতে।
আসুন, আমরা এই পবিত্র ইবাদতের মাহাত্ম্য হৃদয় দিয়ে উপলব্ধি করি, ইতিহাসকে জানি এবং ঈমানের গভীরতা থেকে এর প্রতি আমাদের প্রেম ও শ্রদ্ধা বাড়াই।