ইসলামে উমরাহ একটি গুরুত্বপূর্ণ ইবাদত,
যা মুসলমানদের আত্মশুদ্ধি, গুনাহ মোচন এবং আল্লাহর নৈকট্য অর্জনের অন্যতম মাধ্যম।
এটি হজের মতো ফরজ নয়, তবে অত্যন্ত ফজিলতপূর্ণ একটি ইবাদত। ‘উমরাহ’ শব্দের অর্থ হলো
‘পরিদর্শন’ বা ‘জিয়ারত করা’। ইসলামী শরীয়তের পরিভাষায়, ইহরাম অবস্থায় নির্দিষ্ট কিছু
আমল সম্পাদনের মাধ্যমে মসজিদুল হারামে গিয়ে কাবা শরিফের তাওয়াফ করা, সাফা-মারওয়া পাহাড়ের
মধ্যে সাঈ করা এবং চুল ছোট বা মুন্ডন করার মাধ্যমে উমরাহ সম্পন্ন করা হয়।
রাসূলুল্লাহ ﷺ বলেছেন,
"এক উমরাহ থেকে পরবর্তী উমরাহ—এই দুইয়ের মধ্যবর্তী সময়ে সংঘটিত
গুনাহসমূহের কাফফারা। আর আর হজে মাবরুরের প্রতিদান জান্নাত ছাড়া আর কিছু নয়।"
(সহিহ বুখারি, হাদিস: ১৭৭৩)
অন্য একটি হাদিসে বলা হয়েছে,
"রমজান মাসে উমরাহ করা হজের সমতুল্য।" (সহিহ বুখারি,
হাদিস: ১৮৬৩)
এ হাদিস থেকে বোঝা যায় যে, বিশেষত রমজান
মাসে উমরাহ পালন করা অত্যন্ত ফজিলতপূর্ণ, যা হজের সওয়াবের সমান মর্যাদাপূর্ণ। রাসূলুল্লাহ
ﷺ নিজেও জীবদ্দশায় চারবার
উমরাহ করেছেন, যা উমরাহর গুরুত্ব ও মাহাত্ম্যকে আরও সুস্পষ্ট করে তোলে।
মক্কার পবিত্র পরিবেশে গিয়ে উমরাহ পালন করলে
একজন মুসলিম তার পাপ মোচনের সুযোগ পায় এবং নতুন করে জীবন শুরু করার অনুপ্রেরণা লাভ
করে। এটি আত্মার প্রশান্তি আনার পাশাপাশি দুনিয়া ও আখিরাতে কল্যাণ বয়ে আনে।
কোরআনের আলোকে উমরাহর ফজিলত ও তাৎপর্য
উমরাহ পালনের আদেশ
আল্লাহ তাআলা কোরআনে উমরাহ পালনের বিষয়ে নির্দেশ দিয়েছেন:
"হজ ও উমরাহ আল্লাহর জন্য পূর্ণ করো..." (সূরা আল-বাকারা: ১৯৬)
এই আয়াত থেকে স্পষ্ট বোঝা যায় যে, উমরাহ পালন করা অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ এবং এটি
একমাত্র আল্লাহর সন্তুষ্টির জন্যই করা উচিত।
হারাম শরিফের মর্যাদা
মক্কার মসজিদুল হারাম মুসলমানদের জন্য সবচেয়ে পবিত্র স্থান। যারা উমরাহ করতে
সেখানে যান, তারা সরাসরি আল্লাহর ঘরে হাজির হন। আল্লাহ বলেন,
"আর (স্মরণ করো) যখন আমি ইবরাহীম ও ইসমাঈলকে আদেশ করলাম, ‘আমার এই গৃহকে
পবিত্র রাখো তাওয়াফকারীদের, ইতিকাফকারীদের, রুকু ও সিজদাকারীদের জন্য।" (সূরা আল-বাকারা: ১২৫)
এই আয়াত থেকে বোঝা যায় যে, কাবা শরিফের তাওয়াফ করা ও মসজিদুল হারামে ইবাদত করা
অত্যন্ত মর্যাদাপূর্ণ, যা উমরাহর অংশবিশেষ।
হাদিসের আলোকে উমরাহর ফজিলত ও তাৎপর্য
উমরাহ পাপ মোচনের মাধ্যম
উমরাহ পালন করলে মানুষের পূর্ববর্তী ছোট গুনাহসমূহ ক্ষমা করা হয়।
রাসূলুল্লাহ ﷺ বলেছেন,-
"এক উমরাহ থেকে পরবর্তী উমরাহ—এই দুইয়ের মধ্যবর্তী সময়ে সংঘটিত গুনাহসমূহের কাফফারা। আর হজে মাবরুরের প্রতিদান জান্নাত ছাড়া আর কিছু নয়।" (সহিহ বুখারি: ১৭৭৩, সহিহ মুসলিম: ১৩৪৯)
এই হাদিস থেকে বোঝা যায় যে, উমরাহ পালন করা ব্যক্তির পূর্ববর্তী
ছোট গুনাহসমূহ মোচন করে দেয়।
রমজানে উমরাহ করার বিশেষ মর্যাদা
উমরাহ সবসময়ই ফজিলতপূর্ণ, তবে বিশেষ করে রমজান মাসে এটি আরও বেশি
মর্যাদাসম্পন্ন। রাসূলুল্লাহ ﷺ বলেছেন,
"রমজান মাসে উমরাহ করা হজের সমতুল্য।" (সহিহ বুখারি: ১৮৬৩, সহিহ মুসলিম: ১২৫৬)
এই হাদিসের অর্থ এই নয় যে, রমজানে উমরাহ করলে হজ ফরজ হওয়ার দায়িত্ব
শেষ হয়ে যাবে, বরং এটি বোঝায় যে, রমজানে উমরাহ করলে অতিরিক্ত সওয়াব লাভ হয়।
দারিদ্রতা দূর হওয়ার মাধ্যম
উমরাহ অর্থনৈতিক কল্যাণের একটি মাধ্যম। রাসূলুল্লাহ ﷺ বলেন,
"হজ ও উমরাহ বারবার আদায় করো, কারণ এ দুইটি দারিদ্রতা ও গুনাহকে এমনভাবে
দূর করে দেয়, যেভাবে হাপর লোহার ময়লা দূর করে।" (তিরমিজি: ৮১০, নাসাঈ: ২৬৩১)
এই হাদিস থেকে বোঝা যায় যে, উমরাহ পালন করলে দারিদ্রতা ও গুনাহ উভয়ই কমে যায়
এবং একজন মুসলিম আল্লাহর কাছে আরও নিকটবর্তী হতে পারেন।
রাসূল ﷺ নিজে উমরাহ করেছেন
নবীজি ﷺ নিজে জীবনে চারবার উমরাহ করেছেন এবং এটি
আমাদের জন্য অনুসরণীয়।
· হুদাইবিয়ার সন্ধির সময় উমরাহ করতে গিয়েছিলেন,
কিন্তু সম্পন্ন করতে পারেননি।
· হুদাইবিয়ার পরবর্তী বছর (৭ হিজরি) কাযা উমরাহ।
· ৮ হিজরিতে মক্কা বিজয়ের পর উমরাহ।
· বিদায়ী হজের সময় উমরাহ।
(ইবন কাসির, আল বিদায়া ওয়ান নিহায়া: ৪/৩০৩)
উমরাহর প্রস্তুতি ও পালন পদ্ধতি: সহজ ও বিস্তারিত
গাইড
উমরাহ
একটি পবিত্র ইবাদত, যা পালন করতে হলে সঠিক প্রস্তুতি ও নিয়ম মেনে চলা জরুরি। এটি সংক্ষিপ্ত
কিন্তু তাৎপর্যপূর্ণ ইবাদত, যেখানে শারীরিক, মানসিক ও আধ্যাত্মিকভাবে প্রস্তুত হওয়া
প্রয়োজন। এখানে ধাপে ধাপে উমরাহর প্রস্তুতি ও পালন পদ্ধতি বিশদভাবে ব্যাখ্যা করা হলো,
যাতে যেকোনো মুসলিম সহজেই এটি বুঝতে ও পালন করতে পারেন।
নিয়ত ও আত্মশুদ্ধি
উমরাহ
যেহেতু ইবাদত, তাই এটি পালন করার আগে নিয়ত বিশুদ্ধ করা জরুরি। শুধুমাত্র আল্লাহর সন্তুষ্টির
জন্য উমরাহ করতে হবে, যেন এটি লোক দেখানোর জন্য না হয়।
প্রয়োজনীয়
কাগজপত্র ও জিনিসপত্র প্রস্তুত করা
উমরাহর
জন্য প্রয়োজনীয় কিছু কাগজপত্র ও ব্যক্তিগত জিনিসপত্র আগেভাগে প্রস্তুত করা উচিত।
কাগজপত্র:
ব্যক্তিগত
জিনিসপত্র:
শারীরিক
ও মানসিক প্রস্তুতি
উমরাহ পালনের ধাপসমূহ
উমরাহ
মূলত চারটি প্রধান ধাপে সম্পন্ন হয়: ইহরাম, তাওয়াফ, সাঈ এবং চুল কাটার মাধ্যমে হালাল
হওয়া। প্রতিটি ধাপের বিস্তারিত ব্যাখ্যা নিচে দেওয়া হলো।
ইহরাম বাঁধা ও নিয়ত করা
ইহরাম কীঃ ইহরাম হলো বিশেষ ধরণের পোশাক পরিধান করা ও নির্দিষ্ট
কিছু নিয়মের মধ্যে থাকা, যা উমরাহর প্রথম শর্ত।
ইহরাম বাঁধার স্থান বা
মীকাতঃ উমরাহ করতে গেলে নির্দিষ্ট
জায়গায় পৌঁছানোর আগেই ইহরাম বাঁধতে হয়। এসব জায়গাকে বলা হয় "মীকাত"।
বাংলাদেশ থেকে যারা বিমানে যান, তাদের জন্য মীকাত হলো কারনুল মানাযিল।
অন্নান্য মিকাত সম্পর্কে জানতে
পড়ুনঃ মিকাত এর বর্ননা
ইহরাম
বাঁধার নিয়ম:
তালবিয়া
পাঠ করা: ইহরাম বাঁধার পর তালবিয়া পাঠ করতে হয়:
মক্কায়
প্রবেশ ও মসজিদুল হারামে যাওয়া
মসজিদুল
হারামে প্রবেশঃ ডান পা দিয়ে প্রবেশ
করে দোয়া পড়ুন: "বিসমিল্লাহ, ওয়াসসালাতু ওয়াসসালামু ‘আলা রাসূলিল্লাহ, আল্লাহুম্মা
ইফতাহ লী আবওয়াবা রহমাতিকা"
তাওয়াফ (কাবার চারপাশে প্রদক্ষিণ করা)
তাওয়াফ
করার নিয়ম:
তাওয়াফ
করার সম্পুর্ন গাইডলাইন দেখুনঃ তাওয়াফ করার নিয়ম এবং দোয়া সমূহ
সাঈ (সাফা-মারওয়ার মাঝে দৌড়ানো)
সাঈ
করার নিয়ম:
সাঈ করার সম্পুর্ন গাইডলাইন দেখুনঃ তাওয়াফ করার নিয়ম এবং দোয়া
সমূহ
চুল কাটার মাধ্যমে উমরাহ সম্পন্ন করা
চুল
কাটার পর ইহরামের সব বিধিনিষেধ উঠে যাবে এবং উমরাহ সম্পন্ন হবে।
উমরাহ সংক্রান্ত সাধারণ জিজ্ঞাসা ও সমাধান
উমরাহ পালন করতে গিয়ে অনেকের
মনেই নানা প্রশ্ন জাগে। এখানে কিছু সাধারণ জিজ্ঞাসা ও তাদের সমাধান দেওয়া হলো, যা উমরাহ
করতে ইচ্ছুক ব্যক্তিদের জন্য সহায়ক হবে।
১.
উমরাহ কখন করা যায়?
উত্তর: উমরাহ বছরের যেকোনো সময় করা যায়। তবে হজের সময় (৯-১৩
জিলহজ) উমরাহ করা নিষেধ।
২.
উমরাহ কি বাধ্যতামূলক?
উত্তর:
উমরাহ ফরজ নয়, তবে এটি একটি গুরুত্বপূর্ণ
সুন্নাত মুআক্কাদা (নিয়মিত পালনের সুন্নাত)। তবে যারা সামর্থ্যবান, তাদের জন্য এটি
অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ।
৩.
উমরাহ করার আগে কি কোনো মানসিক বা শারীরিক প্রস্তুতি নেওয়া দরকার?
উত্তর:
হ্যাঁ, কারণ উমরাহতে অনেক হাঁটাহাঁটি
করতে হয়। তাই আগে থেকেই কিছুদিন হালকা ব্যায়াম ও নিয়মিত হাঁটাচলা করলে ভালো হয়।
৪.
নারীরা কি একা উমরাহ করতে যেতে পারবেন?
উত্তর:
ইসলামী শরীয়তে নারীদের মাহরাম (স্বামী/বাবা/ভাই/পুত্র)
ছাড়া দূরের সফর করা নিষিদ্ধ। তবে বর্তমান সৌদি আইন অনুযায়ী, ৪৫ বছরের বেশি বয়সী নারীরা
নির্ভরযোগ্য দলের সাথে মাহরাম ছাড়া উমরাহ করতে পারেন।
৫.
উমরাহর জন্য ইহরাম কোথায় বাঁধতে হয়?
উত্তর:
নির্দিষ্ট স্থান (মীকাত) থেকে ইহরাম
বাঁধতে হয়। বাংলাদেশ থেকে বিমানে গেলে "কারনুল মানাযিল" মীকাত থেকে ইহরাম
বাঁধতে হয়।
৬.
ইহরাম অবস্থায় কি সুগন্ধি ব্যবহার করা যাবে?
উত্তর:
না, ইহরাম অবস্থায় কোনো সুগন্ধি ব্যবহার
করা সম্পূর্ণ নিষিদ্ধ।
৭.
উমরাহ করতে গিয়ে যদি কোনো ভুল হয়ে যায়, তাহলে করণীয় কী?
উত্তর:
যদি ছোটখাটো ভুল হয়, তবে তওবা করতে
হবে। তবে কোনো ওয়াজিব কাজ ছেড়ে গেলে "দম" (একটি পশু কোরবানি করা) বা সদকা
দিতে হবে।
৮.
উমরাহর জন্য কি মাথা ন্যাড়া করা জরুরি?
উত্তর:
পুরুষদের জন্য মাথা ন্যাড়া করা সুন্নাত,
তবে চুল ছোট করলেও উমরাহ সম্পন্ন হবে। মহিলারা সামান্য চুল কাটবেন (আঙুলের এক গিঁট
পরিমাণ)।
৯.
উমরাহর সময় কোন ভুলগুলো এড়িয়ে চলা উচিত?
উত্তর:
১০.
উমরাহর তালবিয়া কখন পড়তে হয়?
উত্তর:
ইহরাম বাঁধার পর থেকে শুরু করে মসজিদুল
হারামে প্রবেশের আগ পর্যন্ত তালবিয়া পড়তে হয়।
১১.
উমরাহ করার সময় হাজরে আসওয়াদ চুম্বন করা কি বাধ্যতামূলক?
উত্তর:
না, এটি সুন্নাত। যদি সম্ভব হয়, তবে
চুম্বন করা যায়। না পারলে দূর থেকে হাত তুলে ইশারা করাই যথেষ্ট।
১২.
উমরাহর সময় যদি মাসিক শুরু হয়, তাহলে করণীয় কী?
উত্তর:
১৩.
শিশুর জন্য উমরাহর নিয়ম কী?
উত্তর:
শিশুর পক্ষ থেকে অভিভাবক ইহরামের নিয়ত
করিয়ে দেবেন এবং তাকে উমরাহর প্রতিটি ধাপে সাহায্য করবেন। শিশুর মাথার চুলও কাটতে হবে।
১৪.
উমরাহর পর মদীনায় যাওয়ার আগে কি নতুন করে ইহরাম বাঁধতে হবে?
উত্তর:
না, মদীনায় যাওয়ার জন্য ইহরামের প্রয়োজন
নেই। তবে মদীনা থেকে মক্কায় ফিরে আবার উমরাহ করতে চাইলে তানঈম (মসজিদে আয়েশা) থেকে
ইহরাম বাঁধতে হবে।
১৫.
উমরাহর পর কি সাধারণ পোশাক পরা যাবে?
উত্তর:
হ্যাঁ, উমরাহ সম্পন্ন হলে ইহরামের
বিধিনিষেধ উঠে যায় এবং সাধারণ পোশাক পরা যায়।
সর্বোপরি, উমরাহ হল একটি সৌভাগ্যের সফর,
যেখানে একজন মুমিন আল্লাহর ঘর কাবা শরিফে গিয়ে নিজের আত্মাকে শুদ্ধ করার সুযোগ পায়
এবং তার জীবনকে আরও আলোকিত করতে পারে। যায়। আল্লাহ আমাদের সবাইকে এই পবিত্র ইবাদত পালনের
তাওফিক দান করুন—আমিন! 🤲